দেয়ালে ঘষটা লেগেছিল।
দিনে কটা মিথ্যে বলা হয় চাঁদু?
লোকটাকে না চিনলেও, ওর কথাগুলো শুনতে ফটিকের ভাল লাগছিল না। ও ঠিক করল, হারুনদা এলে ওকে বলবে।
জবাব দিচ্ছ না যে?
লোকটা এখনও একদৃষ্টে চেয়ে আছে ওর দিকে। ঠিক এই সময় উপেনবাবু রাস্তার দিকের দরজা দিয়ে ঢুকলেন। ফটিককে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সন্দেহ হওয়াতে বললেন, কী হয়েছে?
ফটিক বলল, বাবু জিজ্ঞেস করছিলেন—
কী?
আমি কদ্দিন এখানে কাজ করছি, তাই।
উপেনবাবু ষণ্ডার দিকে চেয়ে বেশ নরম ভাবেই বললেন, কেন মশাই, কী দরকার আপনাদের?
ষণ্ডা কিছু না বলে পয়সাটা টেবিলের উপর রেখে উঠে পড়ল, আর সেই সঙ্গে অন্য লোকটাও। কাজের চাপে বিকেল হতে-না-হতে ফটিক লোক দুটোর কথা প্রায় ভুলেই গেল।
০৮. হারুন উপেনবাবুর দোকানে এল
বিকেল চারটে নাগাদ হারুন উপেনবাবুর দোকানে এল। সে কদিন থেকেই বলে রেখেছে, সে কোথায় থাকে সেটা ফটিককে দেখিয়ে দেবে। উপেনবাবুকে বলাতে উনি রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, বাকি ঘণ্টা-তিনেকের কাজ কেষ্টর ছেলে সতু চালিয়ে নিতে পারবে। সতু মাসে তিনবার করে জ্বরে পড়ে; না হলে কাজ যে একেবারে জানে না, তা নয়।
হারুন দোকান থেকে বেরিয়ে ফটিককে বলল, আজ এমন একটা আর্ট দেখাব তোকে যে, তুই ব্যোমকে যাবি। কথাটা শুনে ফটিকের মন এমন নেচে উঠল যে, উলটো দিকের ফুটপাথের পানের দোকানের সামনে সকালের সেই দুটো লোককে ও দেখতেই পেল না।
হারুনদা ঝুলে ঝুলে বাসে চড়ে না, কারণ তাতে তার হাতের ক্ষতি হতে পারে। হাত না চললে পেট চলবে না রে ফটকে, তাই পদব্রজেই বেস্ট।
অনেক অলিগলি ছোট বড় মাঝারি রাস্তা পেরিয়ে হারুন আর ফটিক শেষটা ব্রিজের উপর পৌঁছল, যেটার তলা দিয়ে ইলেকট্রিক ট্রেন যায়। ব্রিজ থেকে একটা সিঁড়ি নেমে গিয়ে একটা বস্তিতে পড়েছে। এই বস্তিতেই থাকে হারুনদা। ফটিক ব্রিজের উপর থেকেই দেখল, অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে বস্তিটা। দূরে এখানে-ওখানে কারখানার চিমনি দাঁড়িয়ে আছে নারকেল গাছের উপর মাথা তুলে। বস্তিটাকে দেখে ফটিকের মনে হল, সেটা যেন একটা ধোঁয়ার কম্বল মুড়ি দিয়ে রয়েছে। হারুনদা বলল, সেটা উনুনের ধোঁয়া; সন্ধের মুখে ঘরে ঘরে উনুন জ্বলেছে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হারুন বলল, এখানে হিন্দু মুসলমান কেরেস্তান সবরকম লোক থাকে, জানিস। আর তাদের মধ্যে এমন এক-একটা আর্টিস্ট আছে না–দেখলে তাক লেগে যায়। জামাল বলে একটা কাঠের মিস্তিরি আমার ঘরে এসে গান শুনিয়ে যায় মাঝে মাঝে, আমি আমার চৌকিতে ঠেকা দিই। কোথায় আছি ভুলে যাই, এমনি তার আর্টের ভেলকি।
দুদিকে খোলার ছাতওয়ালা বাড়ির মধ্য দিয়ে সরু রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে হারুনের বাড়ির দিকে। হারুন আর ফটিক পাশাপাশি হাঁটছে, আর এদিক-সেদিক থেকে আট-দশ-বারো-চোদ্দ বছরের ছেলেমেয়েরা হারুনকে দেখে লাফাচ্ছে, তালি দিচ্ছে, আর তার নাম ধরে ডেকে উঠছে। হারুন সব্বাইকে হাতছানি দিয়ে ডেকে সঙ্গে নিয়ে নিল; বলল, আজ নতুন খেলা! হো!নতুন খেলা!–বলে তারাও সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল। হারুনদার যে এত বন্ধু আছে, সেটা ফটিক জানতই না।
হারুনের ছোট্ট একটা ঘর, তাতে আলো বেশি আসে না, তাই বোধহয় হারুনদা এতরকম রঙচঙে জিনিস ঘরে সাজিয়ে টাঙিয়ে বিছিয়ে রেখেছে। কাপড়, কাগজ, পুতুল, ছবি, নকশা, ঘুড়ি সবকিছুই আছে। কিন্তু তাও দেখলে দোকান বলে মনে হয় না। যেখানে যেটা রাখলে মানায়, সেইটুকুই–তার বেশিও নয়, কমও নয়। ফটিক মনে মনে ভাবল, এটাও নিশ্চয়ই একটা দারুণ আর্ট। এ ছাড়া অবিশ্যি কাজের জিনিসও যতটুকু দরকার, ততটুকু আছে। আর আছে হারুনের সেই বাক্স আর সেই থলি।
এত সব জিনিসের মধ্যে একটা জিনিস এতক্ষণ চাপা পড়ে ছিল, এবার বাতিটা জ্বালতেই সেটার দিকে চোখ গেল ফটিকের।
ওটা কার ছবি হারুনদা?
বাতিটার ঠিক নীচেই বেশ বড় ফ্রেমে বাঁধানো একটা ছোট্ট ছবি। গোঁফে চাড়া দেওয়া ঢেউ-খেলানো চুলওয়ালা একজন লোক সোজা ফটিকের দিকে চেয়ে আছে। তার তলায় খুব ধরে ধরে পরিষ্কার করে কালো কালিতে লেখা–এরিকো রাস্টেলি।
হারুন একটা বিড়ি ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, ও আমার আর-এক গুরু। চোখে দেখিনি কখনও। ইতালিয়ান সাহেব। আমি যে খেলা দেখাই, ও-ও সেই খেলা দেখাত। জাগলিং। প্রায়, একশো বছর আগে। একটা ম্যাগাজিন থেকে ছবিটা কেটে রেখেছিলুম। আমাকে তো চারটে বল নিয়ে খেলতে দেখলি–ও খেলত একসঙ্গে দশটা বল নিয়ে। ভাবতে পারিস? পাঁচটা নয়, সাতটা নয়–একেবারে দশটা! লোকে দেখে একেবারে পাগল হয়ে যেত।
হারুনদা জাগলিং নিয়ে পড়াশুনা করেছে শুনে ফটিক অবাক হয়ে গেল। ও কি তা হলে ইংরিজি পড়তে পারে? ক্লাস এইট অবধি পড়েছিলুম ইস্কুলে, বলল হারুন–চন্দননগরে বাড়ি ছিল আমাদের। বাপের ছিল কাপড়ের দোকান। মাহেশের রথের মেলায় ভাল ভোজবাজি হচ্ছে শুনে চলে গেলুম দেখতে। দু দিনের জন্য হাওয়া। ফাস্ কেলাস জাগলিং, জানিস। কিন্তু ফিরে আসতে বাপ দেখিয়ে দিলেন আর একরকম জাগলিং। কাপড় কাটার ঢাউস কাঁচি হয় দেখেছিস? এই দ্যাখ তার রেজাল্ট।
হারুন শার্ট তুলে পিঠে একটা গর্ত দেখিয়ে দিল।
তিন হপ্তা লেগেছিল ঘা শুকুতে। তারপর একদিন মওকা বুঝে পকেটে এগারোটি টাকা আর কাঁধে পুঁটলি নিয়ে দুঙ্গা বলে বেরিয়ে পড়লুম কাউকে কিছু না বলে। তিনবার ট্রেন বদল করে বিনি-টিকিটে ঝ্যাকড় ঝাকড় করে তিন দিন তিন রাত্তির স্রেফ চা-বিস্কুট খেয়ে শেষটায় একদিন কামরার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি তাজমহল দেখা যাচ্ছে। নেমে পড়লুম। শহরে ঘুরতে ঘুরতে কেল্লায় গিয়েও হাজির হলুম। পিছনে মাঠ, তার পিছনে যমুনা, আর তারও পেছনে দূরে আবার দেখলুম তাজমহল। তারপরেই আমার চোখ গেল উলটো দিকে। কেল্লার গায়ে উপর দিকে বারান্দা, তার নীচে বাইরে ঘাসের উপর খেলা হচ্ছে। একপাশে সাপ খেলছে, একপাশে ভালুক নাচছে, আর মধ্যিখানে, আসাদুল্লা দু হাতে বল নাচাচ্ছে–তার চোখ রুমাল দিয়ে বাঁধা!…ভক্তি কি সাধে হয় রে ফটকে? গায়ের লোম খাড়া হয়ে চোখে জল এসে গেল। মানুষের এত খ্যামতা হয়?