তোমরা আমার কাছেই থাকবে। তোমরা নীচে, আমি ওপরে। আর রোজগার? ওই দোকানের তুমিও একজন অংশীদার, কর্মী হবে। কত টাকা চাই? একবস্তা, দু-বস্তা। শঙ্কর! মেয়েটা দেবী। পরে বুঝবে।
আপনি আমার নাম জেনে ফেলেছেন?
এ আশ্চর্যের কিছু নয়। একদিন তুমিও পারবে।
আমাকে তো কিছুই করালেন না!
আমি তো তোমাকে দিয়ে যাব। তোমার কিছু করার দরকার নেই। আমার মতো জীবন-মরণ কষ্ট তোমাকে করতে হবে না। তুমি ভালোবাসো। ওর চেয়ে শ্রেষ্ঠ সাধনা আর নেই। আজ পূর্ণিমা। ওই জায়গাটার মাথার ওপর থালার মতো চাঁদ। রুপোলি আলোর বন্যা। সেই আলোয় সবাই চকচক করছে। রং-বেরঙের পোশাক। গরম গরম খাবার ধোঁয়া ছাড়ছে। মশলার গন্ধ। চাঁদের পাশ দিয়ে সাদা পক্ষীরাজের মতো ভেসে যাচ্ছে হালকা একখণ্ড মেঘ। তোমাদের নিয়ে আজ আমরা খুব আনন্দ করব। মানুষই হাসে, মানুষই কাঁদে। ভগবানের সুখ-দুঃখ নেই, তাই তাঁর কিছু নেই। সাক্ষী পুরুষ। তুমিই মরবে, তুমিই বাঁচবে, তুমিই কাঁদবে, তুমিই হাসবে। প্রেমও তোমার, ঘৃণাও তোমার। তোমারই রোগ, তোমারই আরোগ্য। পাহাড় ঘেরা মধ্যপ্রদেশের ভীষণ অরণ্যে পার্বতী আমাকে বারোটা বছর সাধন করিয়েছে। তিন-তিনবার আমাকে সাপে কামড়েছে, তিনবারই পার্বতী আমার বিষ তুলে নিয়েছে। কাঁপালিকরা মহাকালের কাছে আমাকে বলি দিতে চেয়েছে। পার্বতী রক্ষা করেছে। অঘোরীরা আমার দেহ খণ্ড খণ্ড করতে চেয়েছে। পার্বতী চামুণ্ডা মূর্তি ধরে আমাকে রক্ষা করেছে। প্রেত পিশাচের দুনিয়ায় কুণ্ডলিনীর শক্তি ছাড়া তুমি এগোবে কি করে! সব শেষে এই হিমালয়।
তখন আর দেহ নয়, মন। পার্বতী কামরূপ-কামাখ্যার বজ্রযোগিনী। বৌদ্ধ-তন্ত্রে সিদ্ধা। মারণ, উচাটন-বশীকরণ, কামকলা তার আয়ত্তে। তার বশীকরণ শক্তিতে আমার স্মৃতি যেমন লোপ পেয়েছিল, আবার ফিরে এল শুধু এক জন্মের নয়, জন্ম-জন্মান্তরের স্মৃতি নিয়ে। কাল কী হয়েছিল এটা মনে রাখা অতীত জ্ঞান নয়। পূর্বজন্মই অতীত, পরজন্মই ভবিষ্যৎ। পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকারকে টেনে বের করে আনাই ডাকিনী বিদ্যা। তোমাকে বলিনি আগে, আজ বলছি, আমি হাততালি দিলে, যে শুনবে সে-ই সম্মোহিত হবে। সব ভুলে যাবে। যেটুকু মনে করাব, সেইটুকুই মনে পড়বে। দশমহাবিদ্যার সমস্ত রূপ পার্বতী আমাকে দেখিয়েছে। ক্ষুদ্র, সঙ্কীর্ণ সংসারে আমার স্থান হল না। আমার শেষ গতি ওই গুহায়। তোমাকে কেন যেতে দিইনি জানো, ঢুকলে আর বেরোতে পারবে না। তুমি এখনও যুক্তিবাদী, প্রচলিত বিজ্ঞানেই বিশ্বাসী। স্বাভাবিক। এখনও জীবনের অনেকটাই তোমার দেখা বাকি। যে-অরণ্যে আমাদের বারোটা ভয়ংকর বছর কেটেছে, সেখানেই মহাভারতের কালে মহামুনি বশিষ্ঠদেবের আশ্রম ছিল। শঙ্করাচার্য সাধনা করেছিলেন। এইখানেই অঘোরীরা তারা দেবীর শিলায় তাঁকে বলি দিতে গিয়েছিল। শঙ্কারাচার্যের অতি প্রিয়, অনুগত শিষ্য পদ্মপাদ তাঁকে রক্ষা করেন। পদ্মপাদনৃসিংহের উপাসক ও সিদ্ধ ছিলেন। তিনি নৃসিংহ মূর্তি ধারণ করে অঘোরীদের চক্র তছনছ করে দিয়েছিলেন। বর্তমান মুছে যায়, অতীত মোছেনা। বর্তমান অতীতে স্থায়ী হয়, তখন গল্প নয়, কল্পনয়, ইতিহাস। এত বড় ভূমিকার পর সেই অবিশ্বাস্য কথাটা বলি, ওই গুহার মধ্যে বুদ্ধদেবের আসন। অমিতাভ বুদ্ধ। তিনি আসেন, আবার চলে যান, আবার আসেন। কেউ জানেই না, ওখানে একটা গুহা আছে। কেউই আমাদের ছেড়ে চলে যাননি, বুদ্ধদেব, যিশু, মহাপ্রভু, পরমহংসদেব, স্বামীজি, সারদা মা, সিস্টার নিবেদিতা। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছেন। ডাকলেই দেখা দেন।
৪. আশ্চর্য রকমের ঝকঝকে আকাশ
আশ্চর্য রকমের ঝকঝকে আকাশ, আর থালার মতো সেই চাঁদ। অবাক হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে। আভাস পেয়েছে, আজ বিশেষ একটা কিছু হবে। ক্লান্ত যাত্রীদল চটিতে চটিতে। আজকের মতো চলা শেষ। ধাবায় আজ একটু বেশি লোক। অনেক পাগড়িধারী। সম্ভবত রাজস্থানের যাত্রী। গেরুয়া আলখাল্লা পরা কয়েকজন। একজনের কোলে সারেঙ্গির মতো একটি বাদ্যযন্ত্র। আমি অন্যদিনের মতো সহজ হতে পারছি না। কুংকুকে আজ ভীষণ সুন্দরী, অনেক বেশি প্রাণচঞ্চল দেখাচ্ছে। সে কি জানতে পেরেছে, আজ বিশেষ কিছু হবে! একবার মাত্র তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। বেশ ভয় করছে। এক দিকে এত প্রাণ, আর আমি একেবারেই নিষ্প্রাণ। কী যে আমার জীবনদর্শন! কি যে আমি চাই! নিজের জীবন নিয়ে খেলা। বোবা প্যাঁচার মতো চুপ করে বসে আছি।
চাঁদ যেন তরতর করে উঁচু পাহাড়টার মাথায় চড়তে যাচ্ছে। দুটি শৃঙ্গ, একটির নাম জয়, আর একটি বিজয়। চাঁদের অনেকটা কাছে আছি, তাই এত ভালো। গলা কাঁচের মতো চারপাশে থইথই করছে। জায়গাটা ক্রমশই নির্জন হয়ে আসছে। পাতার ফাঁকে ফাঁকে বাতাসের হুসহুস শব্দ। কোন তলানিতে পড়ে আছে উত্তর কলকাতার জীবন! অথর্ব জমিদার, পাগল, আধপাগল সব বংশধর। শ্যাওলা-ধরা বিভিন্ন বয়েসের মেয়েরা। চোখ দিয়ে শরীর লেহন। যৌন বিকৃতি। খালি হয়ে আসা সিন্দুক। যক্ষপুরীর গয়না। সব গঙ্গার গ্রাসে চলে যাক না।
কাঁধে হাত রেখে প্রবধবাবা বললেন, এইবার চলো।
কোথায় যাব?
পেছনের ঘরে।
একটা হাত আমার কাঁধে, আর একটা হাত কুংকুর কাঁধে। পেছন দিকে বেশ বড় একটা ঘর। পাথর ধাপে ধাপে নেমে গেছে খরস্রোতা নদীতে। তারপর পাহাড়। ঘরের মাঝখানে পুরু কম্বলের ওপর বসে আছেন, মা জগদ্ধাত্রী না কি?কী রূপ! পেতলের মতো ঝকঝকে। দু চোখে বিদ্যুৎ। ছুরির মতো গলার স্বর, এসো শঙ্কর, তোমার জন্যেই বসে আছি।