হঠাৎ এক ঝলক রোদ? চারপাশ যেন খলখল করে হেসে উঠল। কুয়াশা পালাবার পথ পাচ্ছে না। দূরে অন্নপূর্ণা রেঞ্জ। এভারেস্টের চূড়া দেখা যাচ্ছে। পেছন থেকে মাথা তুলে আছে। এ ডাকছে কুংকু, ও ডাকছে কুংকু। হলুদ পোশাক পরা মেয়েটি চরকিপাক খাচ্ছে। এতটুকু বিরক্তি নেই তার। সব সময় একটা সুর গুনগুন করছে। এরই ফাঁকে আমাকে একটা সাদা। ফুল উপহার দিয়ে গেল। কাজ করতে করতে দূর থেকে দেখছে। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। কিছু বলতে চায় ফোঁটা ফুলের ভাষায়। আমি বিদেশি হলেও ফুলের ভাষা সর্বত্র এক।
কুংকু তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। কদিন থেকে দেখছি। ষোলো থেকে কুড়ি বসন্তকাল। তিরিশের পর পাতা ঝরা। তারপর বরফ। শ্বেত ভল্লুক। ঝাঁপসা কুয়াশা। সব পাতা ঝরে। গেছে। আঁকাবাঁকা সরু সরু ডাল। তখন অন্য ভাষা, ভিন্ন সুর। ওকে নিয়ে একদিন বেড়াতে যাবে ওই ওপরে, চমৎকার একটা জায়গা আছে পাথরের আড়ালে, একেবারে আকাশের গায়ে। হৃদয়ে হৃদয় ঠেকিয়ে নারীর বুকের ভাষা শুনবে। সেই একই কথা আদি থেকে অন্তে।
আপনি কবিতা লিখতেন?
না, কখনই না। ভীষণ বিষয়ী, স্বার্থপর, ভোগী।
যাক, নিজেকে চিনতে পেরেছেন! কজন পারে!
কুংকুই খাবার নিয়ে এল। গরম ধোঁয়া ছাড়ছে। আজ তার সাহস বেড়েছে। যাওয়ার সময় এমন ভাবে ঘুরল, যাতে তার পেছনটা আমার কাঁধে ঠেকে যায়। এ আমার কি নিয়তি! জমিদারবাড়ির মন্দিরে রোজ সন্ধ্যারতির সময় ইচ্ছে করে আমার পা মাড়িয়ে দিত। একদিন আমার জামার পকেটে অজ্ঞাতে একটা কাগজের টুকরো ঢুকিয়ে দিয়েছিল। লেখা ছিল বোকচন্দর। আমার মা নেই। থাকলে জিগ্যেস করতুম, মা, ওরা কেন এমন করে!
কুংকু গরম ডাল এনেছে। আকুল করা গন্ধ। যাবার সময় আরও সাংঘাতিক কাণ্ড করে গেল। একটা চামচে ইচ্ছে করে মেঝেতে ফেলল, তারপর তোলার সময় হাঁটুতে হাতটা রেখে ঝট করে তুলে নিল। কীসের ইঙ্গিত! এত বড় একটা পৃথিবীতে ছোট্ট এতটুকু একটা ঘটনা। পৃথিবীতে কত বড় বড় শব্দ; তার মধ্যে ছোট্ট টুনটুনির এতটুকু ঠোঁটের টুইট টুইট শব্দ কান কেড়ে নেয়।
ঝলমলে রোদই যখন উঠল, আমরা তখন একটু নীচের দিকে নামতে পারি তো?
সবই আপনার ইচ্ছে। আমার ইচ্ছে বলে কিছু নেই।
যথেষ্ট ভেবেচিন্তে বলছ তো?
একেবারে।
নীচে ছোট্ট সুন্দর একটা বাজার আছে। পাহাড়ের ওপর থেকে দুধের ধারার মতো ওই যে ঝরনাটা নামছে, ওখানে ভারি সুন্দর ছোট্ট একটা নদী হয়েছে। সেই নদীর ধারে একটা। পাহাড়ি গ্রাম। মানুষগুলো খুব ভালো। কতরকমের সুন্দর সুন্দর জিনিস তৈরি করে। হাতের কাজ। এখানে মানুষের খারাপ হওয়ার উপায় নেই, উপাদান নেই। কিছু নেশা-ভাঙ আছে। তা থাক। মহাদেবের দান। জায়গাটা আমার ভালো লাগে। ওখানে তন্ত্র আছে। পার্বতীরা আছেন। তাঁদেরই আধিপত্য, শাসন। ভৈরবদের হম্বি-তম্বি করার উপায় নেই। মা কালীর তারার রূপ। শিবের বুকে চড়ে বসে আছেন। বড় রহস্যময় জায়গা। গেলেই বুঝতে পারবে। মহাভারতের যুগে ওখানে কি হত কে জানে!
প্রায় আধঘণ্টার উতরাই পথ। সত্যই সুন্দর। তাসের ঘর-বাড়ি। সুন্দর সুন্দর রং। সরু সরু পথ ভেতর দিকে, নদীটার দিকে চলে গেছে। কলকল, খলখল শব্দ। ছোট ছোট তাঁতে স্কার্ফ বোনা হচ্ছে। অপূর্ব রঙের বাহার। পুরুষের দেখা নেই। মেয়েদের রাজত্ব। চতুর্দিকে শক্তির খেলা।
এসো, খুব ভালো দেখে একটা স্কার্ফ কিনি।
কার জন্যে?
তোমার জন্যে।
আমি কী করব?
দেবে। একজনকে উপহার দেবে। তোমার প্রেমিকাকে।
আমার প্রেমিকা? সে কে?
তুমি অন্ধ নাকি? দেখতে পাও না! তার নাম কুংকু।
কি বলছেন আপনি।
একটু আগে কি বললে? আমি যেমন চালাব। কুংকুর সঙ্গে তোমার বিবাহ দেব।
এ আপনি কি বলছেন? এদের সমাজ, ভাষা, সংস্কৃতি সব আলাদা। এরা আমাকে গ্রহণ করবে কেন?
প্রেমের একটিই ভাষা, একটাই জাত, একটাই বিধান, অভিধান, একটিই কথা, ভালোবাসি। আবির্ভাব মন্দিরে, মসজিদে, গির্জায় নয়, মানুষের অন্তরে, নদীর গর্জন নয়, ছোট ছোট তরঙ্গ, বিরাট বিরাট পাথর, ছোট ছোট রং-বেরঙের নুড়ি। ঝড় নয় পাতা কাঁপানো ছোট ছোট বাতাস, তোমার, আমার শ্বাসের মতো। ঘাড় ছুঁয়ে যায়, গলার কাছে খেলা করে। পাতলা দুটো ঠোঁটের তুলি-স্পর্শ, মৃদু দংশন। শরীরে কদম্বের জাগরণ। অত বড় নারায়ণ ছোট্ট একটি শালগ্রাম। মানুষের ভালোবাসায়, কুরুক্ষেত্রের গোপাল, যোদ্ধা শ্রীকৃষ্ণ, গৃহমাতার কোলে, চুকচুক করে দুধ খাচ্ছেন। ওহো! অধিক উচ্ছ্বাস ভালো নয়। দেখো, এই শালটা কি তোমার পছন্দ?
খুব সুন্দর।
আর তোমার জন্যে এই টুপিটা?
অপূর্ব! আর আপনার জন্যে এই সুন্দর চাদরটা?
পকেটে হাত ঢুকিও না। তোমার সঙ্গে আমার একটা অদ্ভূত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, যদিও আমি তোমার নাম জানি না, তুমিও আমার নাম জানো না।
আপনার নাম সম্ভবত আমি জানি, প্রবোধ।
আশ্চর্য! কি করে জানলে?
গভীর রাতে আপনার কাছে অনেকে আসেন। মজলিশ বসে যায়। সে এক অন্য জগতের ব্যাপার। আপনাকে প্রবোধবাবু, প্রবোধবাবু বলে ডাকেন।
তুমি শুনতে পাও?
স্পষ্ট।
সে কী? তাহলে তুমি অনেকটা এগিয়ে আছে।
বিয়ে করা কি উচিত হবে!
আমি করেছি–পার্বতী আমার গুরু, আমার সহধর্মিণী। আমাকে সে গিলে ফেলে উগরে দিয়েছে। যেমন পার্বতী মহাদেবকে করেছিলেন।
আমার ভয় করছে। প্রথম কথা আমি আপনাকে ছেড়ে থাকতে পারব না। দ্বিতীয় কথা, আমার তো কোনও রোজগার নেই।