তা ভুলবে না। জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে এইবার যা-যা হবে সব মনে থাকবে।
নাম কি হবে? ঠিকানা কি হবে?
সন্ন্যাসীর ওসব থাকে না।
আমি তো সন্ন্যাসী হইনি।
হবে।
যে বস্তাটায় ঠেসান দিয়ে বসেছিলুম তার মধ্যে তুলো আর কাপড় দিয়ে জড়ানো ছিল মড়ার মাথা, হাড়গোড়। পঞ্চমুন্ডি আসনের জিনিসপত্র। সেইটা তুলে নিয়ে বললে, চলল। হাঁটতে পারবে? নিমতলা শ্মশানের উত্তর পাশে একেবারে গঙ্গার ধারে একসার কাঠের গুমটি ঘর। তারপরই যত কাঠ আর বাঁশগোলা। জায়গাটা খুবই অপরিষ্কার। বেশি আলোও নেই, অন্ধকার, অন্ধকার। বাতাসে চিতার গন্ধ, ফুলের গন্ধ, দিশি মদের গন্ধ। ভালোই লাগছে। মনে হচ্ছিল, অনেকদিনের পরিচিত জায়গা। সব যেন চেনা চেনা। মাথাটা ভারী হয়ে আছে। নাকটা থেবড়ে গিয়েছিল। মনে হয় ফুলে গেছে। জোর করে টেনে টেনে শ্বাস নিতে হচ্ছে। অদ্ভুত লাগছিল, আমি কে জানি না। অথচ হাঁটছি, কথা বলছি, গা ছমছম করছে, আবার মেয়েটির খুব কাছে থাকতে ভীষণ ভালো লাগছে। দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। আলো জ্বলল। ঘরে কিছুই নেই। কাঠের মেঝের ওপর একটা মাদুর পাতা। গঙ্গায় জলের শব্দ। শ্মশানের দিকে বহু মানুষের কলরব। হরিধ্বনি। চিতায় চিতায় কাঁচা কাঠ। ভল ভল করে ধোঁয়া উঠছে। আলো পড়েছে। মহাদেবের জটার কুণ্ডলী। খুব ক্লান্ত লাগছিল। মাদুরে শুয়ে পড়লুম। মেয়েটি দরজা বন্ধ করে, আলো নিবিয়ে আমার পাশে শুয়ে পড়ল। নিচু গলায় আদেশ করলে, কেউ আসবে না, জামা-টামা সব খুলে ফেলল। রাস্তার ধুলো, ময়লা, রক্ত, জল সব লেগে আছে। আমিও সব খুলে ফেলছি। তোমাকে অনেকটাই বলে ফেললুম, আর না। এইবার নামার চেষ্টা। ওপর পাহাড়ে মেঘ জমেছে। জোর বৃষ্টি হবে, তখন এই চাতালের ওপর দিয়ে এত বেগে জল ছুটবে, আমরা ভেসে যাব। পাহাড়ে খুব সাবধানে, হিসেব করে। চলতে হয়। পদে পদে মৃত্যু। তুমি আগে নামো, আমি পেছনে আছি। ঝুঁকে নামবে না। পেছন দিকে শরীরটাকে টেনে রাখো, একটুও ভয় পাবে না। আমি আছি।
গুহার ভেতরে শব্দ হচ্ছে।
ভেতরে নয়, জল নামছে। নামো নামো। কুইক, কুইক।
হড়কে, হড়কে প্রায় ধপাস করে নীচে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, কোমরে অদৃশ্য একটা দড়ি বাঁধা রয়েছে। রাস্তা ঢালু হয়ে কিছুটা নামার পর আবার ওপর দিকে ঠেলে উঠছে। একেবারে উঁচুতে আমাদের সেই খাবার জায়গা। আকাশ আজ তেমন পরিষ্কার নয়। দূরে। গভীর খাদ কুয়াশায় চাপা পড়ে গেছে। ওপরের আলো সব নীচে নেমে এসেছে। পথটা তাই ভীষণ স্পষ্ট। বড়-ছোট পাথরগুলোকে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে। ঠান্ডাও খুব। যে কথা বলছে, তারই মুখ দিয়ে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। পাশ দিয়ে কে একজন ঘোড়ায় চেপে ওপর দিকে চলে। গেল। ধাবার মেয়েদের আজ যেন আরও ফর্সা দেখাচ্ছে। গালগুলো সব টাটকা আপেলের মতো লাল। মেয়েরা সব অপ্সরী। সেই তুলনায় পুরুষরা সব কাঠখোট্টা। মুখগুলো ফাটা ফাটা। কপালে বয়েসের ভাঁজ। মেয়েরা সব দশভুজা। খাটুনির শেষ নেই। নীচের নদীটা আজ রহস্যের আড়ালে। জলের শব্দ বেড়েছে। এক ধরনের সাদা ফুলে কিছু কিছু গাছ ছেয়ে গেছে। একেই বোধহয় বলে মন্দার। কয়েকটা পাখি উঁচু ডালে বসে বিষণ্ণ ডাক ডাকছে।
আপনি তখন থেকে একেবারে চুপ। কি ভাবছেন?
বুঝলে, আমি শেষ আদেশের অপেক্ষায় আছি।
সে আদেশ আসবে কোথা থেকে?
আসবে, আসবে। ঘড়ির মতো নিষ্ঠাবান, মনোযোগী হতে হবে। এক মুহূর্তের জন্যেও টিক টিক ছাড়ে না। কোনও ফাঁক নেই। সরু একটি সুতোও গলাতে পারবে না। খড়খড়ে কাঠের বেঞ্চি। কাঠ খুব পবিত্র। সব কাঠেই আগুন আছে। সবই জলেই স্নিগ্ধতা। আবার বিদ্যুৎও আছে। কিশোরী মেয়েটি দু-গেলাস চা দিয়ে গেছে। রান্নার জায়গায় কর্মযজ্ঞ চলছে। হিমালয়ের মশলায় অন্যরকম সুগন্ধ।
আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে। আপনি অনেক অতীতের কথা বলেছেন, আপনার সম্পর্কে লোকের ধারণার কথা বলেছেন, জীবিকার কথা বলেছেন। সেও সবই আপনার প্রথম আমি। তারপর বিস্মৃতি। দ্বিতীয় আমির শুরু। ওই স্মৃতি তো মুছে যাওয়ার কথা। মৃত্যুর পর কিছু মনে থাকে না। থাকে জাতিস্মরদের। তা হলে?
ঠিক। এ প্রশ্ন তুমি অবশ্যই করতে পারো। উত্তরও পাবে, তবে তার আগে আমার কাহিনি আরও কিছুটা বাকি আছে। এখন আমরা দুপুরের খাওয়াটা গরম গরম খেয়েনি। আজ আর বেশিক্ষণ বাইরে থাকা যাবে না।
জীবনে এক একটা সময় আসে যে সময় খাবার ঝোঁকটা অনেক কমে যায়। কনখলের বটতলায় নিরঞ্জনী সাধুদের আখড়ার পাশে এই উদাস মানুষটির সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে জীবনটা ক্রমশই পালটে যাচ্ছে। আত্মীয়-স্বজন সকলের কথাই ভুলতে বসেছি। এখন একমাত্র তুলসীই স্পষ্ট। তাও এক তরফা। তুলসী আমাকে মনে রাখবে কেন? ঠিক সময়ে পণ্ডিতমশাই তার বিবাহ দেবেন। পণ্ডিতমশাইয়ের বয়েস হচ্ছে। সংস্কৃত আর কেউ তেমন শিখবে না। টোল উঠে যাবে। জমিদারিও গুটিয়ে আসছে। জমিদারবাড়িটা খুব সুন্দর ছিল। খিলানের পর খিলান। ঘরের পর ঘর। বড় বড় দালান। লম্বা লম্বা বারান্দা। জাফরি। রোদ পড়লে জাফরি মেঝেতে নকশার ছায়া ফেলত। ঘরে ঘরে দামি আসবাবপত্র। সব মেঝেই মার্বেল পাথরের। এক-একটা অংশ এতটাই নির্জন, দিনের বেলাতেও ভয় করত। সুন্দর। গোপাল-মন্দির, শিবমন্দির, রাধামাধব। বাড়িটা কিন্তু পাপে ভরা। গণিকারাও বেশি রাতে আসত কারও কারও লালসা মেটাতে। বেশিরভাগ মানুষ কামুক। ভোলা মালি নয়, ভোলা ভয়ংকর। ফুলের বাগানে রক্তমাখা ছুরি হাতে ঘোরে। ছোটবাবুর যত অপকর্মের সহকারী। মস্ত বড় একটা মিনার্ভা গাড়ি সদরে। সেই গাড়িতে চেপে নায়িকারা আসে। এই ভোলাই হয় তো একদিন তুলসীকে তুলে আনবে, আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একটা ঘর আছে, মদের ঘর। সেই ঘরের মেঝেতে দুপুরবেলায় আমি মাতাল সুন্দরীকে পড়ে থাকতে দেখেছি। মাইনে করা ফটোগ্রাফার ছবি তুলছে। শরীরের বিশেষ বিশেষ অংশ অনাবৃত করে। লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছি। মেঝেতে আমার পা আটকে গেছে। পরে নিজের দুঃসাহসকে তিরস্কার করেছি। ধরা পড়লেই জ্যান্ত কবর। প্রশ্ন করেছি, তোর এত কৌতূহল কেন? উপন্যাস লিখবি?