সব, সব আমি শুনছি। কয়েকদিন ধরে শুনছি, আর আপনাকে দেখছি। আপনি খাবো বলে খাচ্ছেন না, ঘুমোব বলে ঘুমোচ্ছেন না, অথচ কী সুন্দর আছেন! এই অদ্ভুত অবস্থায় এলেন কী করে? এই স্বাধীনতা! এ তো শুনে বা পড়ে হয় না।
তা হলে স্থির হয়ে বসে শোনো কী হয়েছিল? আমি শহর কলকাতার মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে। জ্ঞান হওয়া থেকেই শুনছি–লেখা, পড়া, পরীক্ষা, পাশ, চাকরি, টাকা, বিয়ে, ছেলেপুলে, সংসার। এর বাইরে বিশেষ কিছু নেই। দম দেওয়া কলের পুতুল। দম দিয়ে ওই পেটাই করা লম্বা রাস্তায় ছেড়ে দাও। গড়গড় করে চলবে। দম হল টাকা। পালিশ হল গোটাকতক ডিগ্রি। বা, বা, বেশ যাচ্ছে, বেশ যাচ্ছে। তালি বাজাও, তালি বাজাও। গুড বয়, স্বার্থপর বয়, শয়তান বয়। আদর্শ বলে কিছু আছে কি? আদর্শ আবার কী? মেয়ে ধরে, খামচাখামচি করে বেঁচে থাকো। দরকার হলে মিথ্যে কথা বলো, ক্ষমতাশালীকে তেল দাও। মোসায়েবি করো। কাজ আদায় হয়ে গেলে স্রেফ ভুলে যাও। এইভাবেই বেশ চলছিল। হঠাৎ একদিন বাস থেকে নামতে গিয়ে মুখ থুবড়ে রাস্তায় পড়ে গেলুম। কেউ আমাকে পেছন থেকে জোরে ধাক্কা মেরেছিল। তারপরে কী হল আমি জানি না। ব্রেক কষার বিকট শব্দ। কিছু চিৎকার। এর পর যখন জ্ঞান হল, দেখলুম, পথের ধারে একটা ঝুপড়িতে চিৎ হয়ে শুয়ে আছি। একটি মেয়ের মুখ আমার মুখের ওপর ঝুঁকে। আমার ঠোঁটের ওপর ঠোঁট রেখে হাওয়া পুরে দিচ্ছে। চোখ চাইতে দেখে বলল, বেঁচে গেছে, বেঁচে গেছে। সুন্দর ধারালো মুখ, পাতলা খাড়া নাক, পাতলা ঠোঁট, এলো চুল আমার মুখের ওপর ঝুলে আছে। যুবতী। আমার মাথাটা তার কোলে।
আমার নাকি প্রাণ ছিল না। পেছনের একটা গাড়ি আর একটু হলেই আমাকে শেষ করে দিত। সবাই মিলে ধরাধরি করে আমাকে তুলে এনেছে। মেয়েটার মধ্যে অলৌকিক একটা শক্তি ছিল। শিবের ভক্ত। প্রত্যেক বছর বাঁক নিয়ে তারকেশ্বরে যায়। তার শক্তির কথা। সকলেই জানে। সবাই সমীহ করে। যে-কোনও বিপদে মানুষ তার কাছে আসে। ঝকঝকে দুটো চোখ মেলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। বেশ বুঝতে পারলুম, আমার ভেতরে কিছু আসছে। তার শ্বাসে ছিল কর্পূরের গন্ধ। আমার মনে হল, এই মেয়েটিকে ছেড়ে আমি কোথাও যেতে পারব না। আমার নতুন জন্ম হয়েছে। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের মধ্যে কিছু একটা হচ্ছে। আদানপ্রদান। কোনও কথা বলতে পারছি না। শব্দ বেরোচ্ছে না। তাকিয়ে আছি সেই রমণীর দিকে। জ্যান্ত মা দুর্গা। সাদা কাঁচুলি। হালকা নীলরঙের পাতলা শাড়ি। সাজিয়ে দিলে সিংহাসনে মহারানি। কালো কুচকুচে চুল পিঠ ছাপিয়ে কোমর পেরিয়ে গেছে। ধীরে ধীরে উঠে বসলুম। মাথা ঘুরছে। মালভরতি একটা বড় বস্তায় ঠেসান দিয়ে বসলুম। সারা শরীরে ব্যথা। হাঁটু দুটোয় বেশি লেগেছে। হাতের তালু দুটো জখম। দুজনে মুখোমুখি বসে আছি। দেখছি, শুধু দেখছি। সে জিগ্যেস করলে, কোথায় থাকো?
কী আশ্চর্য! আমি সব ভুলে গেছি। অতীত মনে পড়ছে না। নাম ভুলে গেছি। জিগ্যেস করলুম, কী হয়েছে আমার?
তুমি মরে বেঁচ্ছে। তোমার নাম কী?
এইবার ভীষণ ভয় পেয়ে গেলুম। নাম মনে পড়ছে না। সর্বনাশ! ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঘুসের টাকার পাহাড়। কাগজপত্তর। পকেটে অনেক টাকা। সঙ্গে এমন কোনও কাগজ নেই, যা দেখে বলতে পারি, নামধাম ঠিকানা। মেয়েটি খিলখিল করে হাসছে আর বলছে, সাধে লোকে আমাকে নাগিনী বলে। আমার ছোবলে বিষ আছে। আমার লালার রং নীল। মুখে ঢুকলে ঘোর হয়। ভর হয়। আমি কী করব? আমার কী করার আছে? সব বাবার কৃপা। সেই বললে কি হয়েছিল আমার। এই মেয়েটি সেই সময় রাস্তা পার হচ্ছিল। যে গাড়িটা আমাকে পিষে দিতে পারত, সেটার টায়ার ফেটে গেল। আমাকে ধরাধরি করে এখানে তুলে আনা হয়েছে। বললে, কোথায় আর যাবে! আমার সঙ্গে নিমতলার শ্মশানেই চলল, এখন। সেখানেই আমি থাকব কিছুদিন। তোমার একটা লক্ষণ আমার ভালো লেগেছে, যা খুব কম। মানুষেই থাকে। তোমার জিভের ডগাটা চেরা। তুমি যদি কারোকে কামড়াও সে মরে যাবে। আমি অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলুম। সে বললে, তোমার পূর্বজন্মের কোনও একটি তোমার ভেতর এসেছে। যেটা ছিল সেটা তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
ঝুপড়িতে কেউ নেই। সে আর আমি বসে আছি। পেছন দিকে অনেকটা জংলা জায়গা তারপর এক জোড়া রেললাইন। তারপর জমিটা ঢালু হয়ে গেছে একটা জলায়। একটা ভয়ের জায়গা। তাকালেই মৃত্যুর চিন্তা আসবে। প্রেত-পিশাচে গলা টিপে ধরছে। রক্তচোষা বাদুড় এসে গলায় দাঁত ফুটিয়ে রক্ত শুষে নিচ্ছে। মেয়েটি আমার খুব কাছে সরে এসে বললে, আমার সঙ্গে যাবে? তোমার খোঁজ তো ওরা করবেই, তোমার বাড়ির লোক। হাসপাতালে যাবে, থানায় যাবে, কাগজে কাগজে ছবি ছাপবে। তখন তো তুমি ধরা পড়ে যাবে। তা হলে?
নিজেকে কেমন শিশুর মতো অসহায় মনে হল। পূর্বস্মতি একেবারে মুছে গেছে। অন্য স্মৃতি জাগছে। পরিষ্কার ধুতি, গোল গলা ফতুয়া পাঞ্জাবি, কাঁধে পাট করা সাদা চাদর, পায়ে চটি, আমি সেরেস্তা থেকে ফিরছি একটা ফিটনে চেপে। একটা নাম বারে বারে মনে পড়ছে সুধা। সুধা কে?নদীর ধারে বাগানঘেরা বাড়ি। পাশেই কালীমন্দির। ঘোরটা কেটে যেতেই বললুম, আমি তোমার। এমন জায়গায় নিয়ে চলো যেখানে আমাকে কেউই খুঁজে পাবে না। কিন্তু তোমাকেও যদি ভুলে যাই?