এই প্রশ্ন আপনার কাছ থেকে আশা করিনি। সন্ধান দিয়েছেন ভগবান। আপনার বিশ্বাস এখনও পাকা হয়নি। কিছু অলৌকিক শক্তি পেয়েছেন, এই মাত্র।
হ্যাঁ, তুমি ঠিক বলেছ। একেবারে ঠিক। তুমিই তাহলে আমার গুরু।
আবার ভুল করলেন। একমাত্র গুরু ভগবান, সচ্চিদানন্দ। কেউ কারও গুরু নয়। তিনি যাকে কৃপা করবেন, যখন করবেন।
বাঃ, বাঃ, এই তো, এই তো, আমার সন্দেহে তোমার বিশ্বাস বেশ পাকা হয়েছে। তুমি এই জ্ঞান পেলে কার কাছ থেকে? তুমি আলোকিত হয়েছ। তিনি একই সঙ্গে জ্ঞানী ও ভক্ত। তিনি বেলুড় মঠের প্রবীণ সন্ন্যাসী। তিনিই আমাকে শ্রীরামকৃষ্ণের জগতে নিয়ে গেছেন। তিনি কত সহজ, কত উদার! আমি ওই মহাপুরুষের আশ্রয়ে বেশ কিছুদিন ছিলুম। সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলুম। তিনি এক কথায় বলে দিলেন, শান্ত, সুন্দর, পবিত্র গৃহী হও। ঠাকুর চলে যাওয়ার পর গৃহীর বড় অভাব। শ্রীহীন পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। সমাজ দূষিত হচ্ছে। জানি না, তিনি আমার স্বভাবে, সংস্কারে কি দেখেছিলেন। তবে এ-ও ঠিক, আপনি একেবারে অন্যরকম রহস্যময়। আপনার আসল দিকটা ধরা যাচ্ছে না।
আরে আমিই কি জানি কি হয়েছে আমার? আমার তো জেলে থাকার কথা। আমি তো আসামি! এই দেখ তোমার মুখের চেহারা বদলে গেল। ঘৃণার ভাব।
ভুল করলেন। আপনার পড়াটা ঠিক হল না। আমি খুনিদের ডেরা থেকে পালিয়ে এসেছি। মিথ্যা অপরাধে আমাকেও ফাঁসানো হত। সে খবরও আমি পেয়েছি। ওই সব বলে আমাকে আর পরীক্ষা করবেন না। একটু আগে পাহাড়ে ওঠার সময় আমি অনুভব করেছি আমি উঠছি না, অদৃশ্য শক্তি আমাকে নিমেষে এই পাথরের চাতালে তুলে দিল। আপনি কোথায় কোন শ্মশানে, কোন গুহায় সাধনা করেছিলেন?
তুমি একটি আধুনিক ছেলে, কি সাধনা, সাধনা করছ। ভোগের দুনিয়ায় চুটিয়ে ভোগ করো, বুড়ো হয়ে মরে যাও। আমিও মরে গিয়েছিলুম, এটি একই শরীরে দ্বিতীয় জীবন। ভাবছ গাঁজাখুরি গল্প! তা ভাবতে পারো। বিশ্বাস তো মনেরই একটা স্তর।
ওই যে বললুম, আপনি এক রহস্য। আমরা গুহায় ঢুকে মহাপুরুষকে দেখব না?
এমন কিছু ঘটবে, যাতে তুমি ভীষণ ভয় পাবে। তুমি তাঁর বালক রূপ দেখলে। তিনি কৃপা করে দেখালেন। আজ এই পর্যন্ত থাক। আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে, তিনি ওই গুহায় নেই, বসে আছেন তোমার পাশে! না, না, ভয় পেয়ো না, আশ্চর্য হয়ো না। হতে পারে, এমন হতে পারে। তুমিও তো একদিন বালক ছিলে, সেই বালকটা কোথায় গেল? তুমি খুন করেছ? এই, এই, দেখেছ আমরা সবাই খুনি। অদৃশ্য খুনি। বিচার হবে না কোনও আদালতে।
আপনি আমার মাথাটা খারাপ করে দেবেন। এইবার আমার সত্যি সত্যি ভয় করছে।
ভয় নেই। তুমি নিরাপদ। এসো, বসা যাক।
আমরা গুহার ভেতরে যাব না?
ভেতরে যাব কেন? ওই তো তিনি এখন পাহাড়চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন, দেখতে পাচ্ছ না?
অনেকটা উঁচুতে, ছোট্ট একটা বিন্দুর মতো। ওখানে কেন? ওখানে নয় কেন?
ঠিক ঠিক। বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলেছি।
আমরা যে স্তরের মানুষ, সেই স্তরে শুধুই কার্য-কারণ। কারণ ছাড়া কাজ অকাজ। উনি ভগবানের মতো নিঃসঙ্গ। সেইটাই উপভোগ করছেন। কেউ কোথাও নেই শুধু আমি আছি। উরেব্বাপরে! ভাবা যায়! পাগল হয়ে যাবে, আত্মহত্যা করে ফেলবে। ভগবানের মন আর। মানুষের মনে অনেক তফাত। তাঁর ভেতর থেকে হু-হুঁ করে কত কি বেরিয়ে আসছে। ওই দেখ, দু-হাত মেলে বুক চওড়া করে কেমন দাঁড়িয়ে আছেন। বড় বড় সাদা চুল, দাড়ি। বাতাসে বুকের ওপর লুটোপুটি খাচ্ছে। দেহ নেই, তাই মৃত্যুভয় নেই।
ওটা তাহলে কী?
আকার।
তার মানে বাষ্প, ধোঁয়া?
আলো হতে পারে, ছায়াও হতে পারে। জড়িয়ে ধরলে দেখা যাবে কিছুই নেই।
মরীচিকা?
তাও হতে পারে। যোগীরা কখন কী করে বসবেন কে বলতে পারে? ওই গুহায় খবরদার ঢুকো না। ওখানে মাঝে মাঝে একটা বাতাস আসে, অজগরের শ্বাস। তোমাকে টেনে নেবে। ধীরে ধীরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। একদিন আমাকে এই পাথরের ওপর বসে থাকতে বলে আমার গুরুদেব ওই গুহায় প্রবেশ করলেন, আর বেরুলেন না। আমি বসেই রইলুম। তিনটে দিন কীভাবে কেটে গেল। একদিন শেষ রাতে একটা কঠিন আদেশকানে এল, বসে আছিস কেন?যা দেওয়ার দিয়েছি, এবার নিজের পথে এগিয়ে যা। আমার ওই কুঠিয়ায় থাকবি। একদিন ওটাও থাকবে না। তখন পথই বলে দেবে পথ। কালের চিন্তা কালই করবে। আমাদের পথে ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। সময়ের বাইরে যাওয়াই আমাদের সাধনা। আমি তো সেই জায়গাটায় যেতে পারিনি। ও কি সহজ নাকি? দেহ আছে মৃত্যু নেই, জন্ম নেই। এই শরীরটাও তো একদিন জন্মেছিল, একটু একটু করে বেড়েছে। সবকটা ইন্দ্রিয়ের তোড় সহ্য করছে, তাহলে?
আশ্চর্য! আপনি আমাকে প্রশ্ন করছেন? আমার কাছে সব কিছুই তো দুর্বোধ্য। আমি জানি, আমি মরার জন্যে জন্মেছি। যে জগতে সবাই বেঁচে আছে, সেই জগতেই আমিও আছি। দিন আর রাত ঘুরে ঘুরে আসছে। বয়েস বাড়ছে।
সে ঠিক আছে; কিন্তু, তুমিই বা এখানে কেন? আমিই বা এখানে কেন? ওই হরিদ্বারের গঙ্গার ধার। সম্পূর্ণ অচেনা একজন। ওঠো, চলো আমার সঙ্গে। এ-পথে অনেকে গেছে। তুমিও চলো। এ কোনও মন্দিরে যাওয়া নয়। জগতের এক স্তর থেকে আর-এক স্তরে যাওয়া। যেমন ফলের পোকা! ক্রমশ ঢুকছে। গভীরে, আরও গভীরে। হরিদ্বার যেন উঠান। হাজার মানুষের মিলন। কোনও ভয় নেই। যে মানুষ এসেছিল, সেই মানুষই ফিরে চলল। কিন্তু, ওখানে ফাঁদ পাতা আছে। সেই ফাঁদে পড়লে তোমার মুখ ঘুরে যাবে। জগতের সব শাস্ত্র সেখানে অচল। পৃথিবীর কোনও ঘড়িতে সেখানকার সময় ধরা যাবে না। সবাই চলছে, যাচ্ছে না কোথাও। দেখলে না, গুহা থেকে তিনটি বালক বেরিয়ে এসেছিল।