অনুমতি দেবে?
অবশ্যই।
তানপুরা ছাড়তে পারো?
পারি।
ওই যে কোণে, দাঁড় করানো। নিয়ে এসো।
আপনার গান আমি একবার শুনেছি।
বেশ করেছ, এখন এই গানটা মন দিয়ে শোনো। গানের বাণী—
পাবি না ক্ষেপা মায়েরে ক্ষেপার
মতো না ক্ষেপিলে,
সেয়ান পাগল কুঁচকিকাল, কাজ
হবে না ওরূপ হলে।।
শুনিসনে তুই ভবের কথা
এ যে বন্ধ্যার প্রসব ব্যথা,
সার করে শ্রীনাথের কথা চোখের
ঠুলি দে না খুলে।।
মায়া মোহ ভোগতৃষ্ণা দেবে
তোরে যতই তাড়া,
বোবার মতো থাকবি, সে কথায়
না দিয়ে সাড়া
নিবৃত্তিরে লয়ে সাথে ভ্রমণ কর
তত্বপথে
নৃত্য কর প্রেমে মেতে, সদা
কালী কালী বলে।।
তোমার হাই উঠছে। ঘুম পেয়েছে।
রাতে ঘুম আসতে চায় না। একটা ঘোর আসে। আর কেবলই এই দৃশ্য স্পষ্ট হতে হতে অস্পষ্ট হচ্ছে, আবার স্পষ্ট হচ্ছে। এই চলতে থাকে সারাটা রাত।
দৃশ্যটা কি?
সেই এক দৃশ্য, শয়নে-স্বপনে। তুলসীমঞ্চের সামনে সন্ধ্যাদীপ হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে এক দেবী। অন্ধকারে একটি আলোর বলয়। কোথাও আর কিছু নেই। বড় একটা গাছের শাখা ঝুঁকে পড়ে দেখছে। ফুটে আছে ধবধবে সাদা একটা ফুল। দুধের মতো সাদা আলো। মনে হচ্ছে, পাগল হয়ে যাব।
হতে বাকি কি? আমরা সময়ের খাঁজে আটকে গেছি। আমাদের জীবনে কোনও ঘটনা নেই। মৃত সময়ে প্রেতের মতো ঘুরছি। অতীতের অস্থি সংগ্রহ করে করে কফিনে রাখছি। এখন রাত ঠিক দুটো। এইবার আমার গুরু আসবেন।
কীভাবে আসবেন, কোথা দিয়ে আসবেন?
মুক্তি আর মুক্ত দুটো শব্দ। বদ্ধ আর আবদ্ধ। হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়াবেন। ভারতের আকাশ জ্যোতির্ময়। মহাপুরুষদের বিচরণ ক্ষেত্র। দেবতাদের ভ্রমণপথ। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে চলে গেছে আলোর রেখা টেনে টেনে। স্মরণ করো, স্মরণ করো! মুহূর্তে চলে যাবে দেবলোকে। ঘুপচি ঘর, বাসি বিছানা, অপরিচ্ছন্ন নারীশরীর, মদের গন্ধ, ছাড়া কাপড়-জামা, মুরগির হাড়, ভ্যাপসা গরম, দুর্গন্ধ। এরই নাম নরক। কামকীটের ভারি পছন্দের স্থান। অন্ধকার আকর্ষণ।
কেঁচোর মাথা তোলা। তুলছে আবার লটকে একপাশে পড়ে যাচ্ছে। মাংস আর মেদের খাঁজে ঢুকে যাচ্ছে। অবিদ্যা, মায়ার সন্তান দল পৃথিবীটাকে ছিঁড়ে খাচ্ছে। লোভের জিভ লকলক। করছে। এদের প্রশ্বাসে সব কালো হয়ে যাচ্ছে। জীবন নিয়ে, ধর্ম নিয়ে ন্যাকামো কোরও না। উত্তর দিকে মুখ করে, চোখ বুজিয়ে বোসো। ঘুমিয়ে পড়ো না।
৩. এই যে দেখছ পথটা
এই যে দেখছ পথটা, এটা ক্রমশ ওপর দিকে উঠে গেছে। আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বড় ছোট পাথরের স্থূপ। মাঝে মাঝে জল চলে আসছে অদৃশ্য সব উৎস থেকে। এটা তীর্থযাত্রীদের পথ নয়, সাধুদের পথ। এইটা পেরোতে পারলেই অদ্ভুত এক চাতাল। সেখান থেকে মাথা তুলেছে ওই বিরাট পাহাড়টা। উঁচু, কত উঁচু, যেন আকাশে ঠেকে গেছে। ওই পাহাড়ে একটা বড় গুহা আছে। সেই গুহায় ধ্যানস্থ এক সাধু। তাঁর পার্থিব শরীর কতটা প্রাচীন, কেউ বলতে পারবে না।
আপনি আগে গেছেন?
অনেকবার।
কথা হয়েছে?
না, একবার শুধু তাকিয়েছিলেন। সে দৃষ্টি আমি সহ্য করতে পারিনি। অন্তর্ভেদী।
আমি কি উঠতে পারব? এ তো দুর্গম!
আমি পারলে, তুমিও পারবে। শরীরটা হালকা করে নাও।
কি করব? হালকা? কেমন করে করব?
শ্বাস নিয়ে ধরে রাখো, কুম্ভক। দেখবে শরীর হালকা হয়ে গেছে। আগেই ভাববে না, পারব না। ভাববে, এ আমার পক্ষে কিছুই নয়। সামনের দিকে একটু ঝুঁকে থাকবে। এপাশে ওপাশে গাছের শেকড় ঝুলে আছে। সাহায্য নিতে পারো। কখনও পাহাড়ে উঠেছ?
না।
এই তোমার প্রথম। আমি তোমার পেছনেই আছি। আজকের দিনটা খুব সুন্দর। রোদ ঝলমলে। দূরের পাহাড় সব ঝকঝক করছে; যেন এক-একজন দেবতা। শিব শিব বলতে বলতে ওঠো। হিমালয় হল শিবভূমি। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় পাহাড় আছে, পাহাড় দেবতা কোথাও নেই। এ হল ঋষিদের অবদান। দেবতারা এখানে মানুষকে কৃপা করে আসতে দেন। সাহায্য করেন। সে-ই আসতে পারে যার সংসার বন্ধন ঘুচে গেছে। এ-পথ গাড়ি-ঘোড়ার পথ নয়, পায়ের পথ। এই দেখ, তুমি কত সহজে উঠে এলে। কিছু বুঝতে পারলে?
আমি উঠিনি। উঠেছেন আপনি।
আমিও উঠিনি। উঠেছেন তিনি।
তিনি? তিনি কে?
যে যেমন বোঝে। শক্তি, শক্তি। মা আর বাবার একত্র শক্তি। জগতের আড়ালে কেমন বসে
আছেন। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় আলোর খেলা খেলছেন। মুঠো মুঠো ছুঁড়ে দিচ্ছেন মহাকাশে, গ্রহ, চন্দ্র, তারা। ওই দেখ, দেখ। তোমার কী ভাগ্য! গুহার বাইরে তিন দেবশিশু। আজ এসেছে, আজ এসেছে।
আশ্চর্য!
তুমি দেখতে পাচ্ছ তো?
ওই তো। কোথা থেকে এল?
গুহার ভেতরে বসে আছেন যে সাধক, তাঁর শরীর থেকে বেরিয়ে এসেছে তিনটি কাল–
অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ। তিনটিই শিশু। দেহ দিয়ে আমরা কাল মাপি–আমার শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য। আসলে এসব কিছুই নেই। স্তব্ধ বিশাল মহাকাল। তিনি চিরকিশোর। ওই দেখ, তিনজনে কেমন বিশাল চাতালে মহানন্দে ছোটাছুটি করছে!
এ কি সম্ভব?
অবিশ্বাস, অবিশ্বাস! সঙ্কারে বহু জন্মের সংসারী মানুষের প্যাঁচ। ভেতরটা জট পাকিয়ে আছে। এসো তোমাকে আমি এই পাহাড়ের ওপর থেকে নীচে ঠেলে ফেলে দি। আমি খুনি। এখানে কেউ নেই। ওই দেখ, তোমার মুখটা ভয়ে কেমন যেন হয়ে গেল। শোনো, যে মানুষ সত্যকে জেনেছে সে খুন হয়ে গেছে। তার আর কোনও বোধ থাকে না, মরে গেছে, না বেঁচে আছে! কী চাও তুমি? আমার সন্ধান তোমাকে কে দিয়েছে?