তুলসীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সুন্দর একটা সংসার করতে তোমার আপত্তিটা কোথায়?
সংসার মানেই ঝামেলা। আমি পরিব্রাজক সন্ন্যাসী হব, দেশ-দেশান্তরে, পাহাড়ে, পর্বতে ঘুরে বেড়াব। নদীর তীরে বটগাছের তলায় বসে ধ্যান করব।
ইচ্ছাটা থাকা ভালো, তবে কতদিন থাকবে, সেইটাই হল কথা। জীবন এক জটিল ব্যাপার। শুয়াপোকার মতো অনেক শুয়া। কতদিকে কতভাবে জড়িয়ে যাবে, তার কোনও শাস্ত্র নেই। অঙ্ক নেই, পদ্ধতি নেই সমাধানের। একটা কিছু ঘটালেই, তার ফল গড়াতে গড়াতে চলল। ঘটনার পর ঘটনায়। ঘটে যাওয়া ঘটনাকে প্রয়োজনে অন্যরকম করা যায় না। একটা লেখা মুছে ফেলে অন্যরকম লেখা যায়। ঘটনাকে মেরামত করা অসম্ভব। জানো না তুমি, বাইরে থেকে দেখছ, তাই আমার ভেতরটা তুমি দেখতে পাচ্ছ না, আমি খুব কামুক। সেই অর্থে আমি চরিত্রহীন। কিছুতেই নিজেকে সংশোধন করতে পারছি না। একটু আগে যেখানে আমরা খেতে গেলুম, সেখানে দেখলে ঘাগরা পরা একটি মেয়ে চাপাটি সেঁকছে!
দেখেছি।
কিছু মনে হয়েছে?
তুমিও বলোনি, আমিও বলিনি। বসে বসে এমন বিষয়ের আলোচনা করতে চাইছি, যা আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। ঊর্ধ্বলোকের। সাধকরা যাকে বলছেন দেবলোক। দেখ, শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তদের একটি কথা বলেছিলেন, যে খায়দায়, আনন্দ করে, যার মনে স্বাভাবিক ভাবেই কোনও বাজে চিন্তা আসে না, একেবারে স্বাভাবিক, সে খুব ভালো, আমি তাকেই পছন্দ করব। ভণ্ডদের আমি আমার ত্রিসীমানায় আসতে দেব না। আমি নিজে কেমন জানো, খাই, দাই, থাকি, আর সব জানেন আমার মা, মা কালী।
দেখুন, আপনাকে আমি চিনেছি। আমার ঘুম পাতলা। কাল মাঝরাতে আপনি বিছানায়। বসেছিলেন ধ্যানস্থ। শরীর ঘিরে একটা আলো। টেলিফোনে কথা বলার মতো কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন। সে সব কথার অর্থ আমার দুর্বোধ্য। সব আলোচনায় আপনি নিজেকে। আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে ফালা ফালা করেন। একজন সার্জেন নিজেকে কাঁটাছেঁড়া করতে পারেন না। আপনি এমন সার্জেন যে নিজেকে টেবিলে শুইয়ে ছুরি চালায়। আপনার লক্ষ্য। কিন্তু সে, যাকে আপনি বলছেন। আপনি হলেন সেই রাঁধুনি–যে হাত পুড়িয়ে রান্না শিখেছে।
সাংঘাতিক মানুষ আপনি। আপনাকে একটা সত্য কথা বলি, তুলসীর সামনে আমি আর কোনওদিন গিয়ে দাঁড়াতে পারব না। আমি আমার মুখ পুড়িয়েছি।
কী করেছিলে?
আমি আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে তার স্নান করা দেখতুম বিভোর হয়ে। একদিন ধরা পড়ে গেলুম। স্পষ্ট বললে, ছি, ছি, তুমি খুব নোংরা ছেলে। তুলসী সন্ধ্যাদীপের পবিত্রতা, আমি নোংরানর্দমা। আমি তাকে বলে এসেছি, যদি শুদ্ধ হতে পারি তবে তোমার সামনে এসে দাঁড়াব। কিন্তু এখনও আমার পরিবর্তন আসেনি। বদমাইশ লোফারটা ভেতরে বসে আছে। দিনে দিনে পুষ্ট হচ্ছে। আমার শরীরটা ব্যবহার করতে চাইছে। আমার প্রভু হয়ে উঠতে চাইছে। আমি প্রেমিক। আমি ভালোবাসতে চাই। যথাসর্বস্ব দিয়ে দিতে চাই। কোথায়? আমার প্রেমিকাকে আমি খুন করেছি। ওপরে ওই পথটা ধরে আমি ঊর্ধ্বে, আরও উর্ধ্বে উঠে যাব। বরফের রাজ্যে হারিয়ে যাব। মরে যাব। দেহটা বরফের স্তরে চাপা পড়ে থাকবে। অনেক অনেক দিন। ভগবান আমি চাই না। কী হবে? আমি প্রাণের মানুষ চাই। তার সুখেই আমার সুখ। আমার ভালোবাসা হবে সেবা। আমি একটা ইডিয়েটের মতো কথা বলছি। হয়তো। মাথামুন্ডু নেই; কিন্তু বলছি। আপনি বলেই বলছি। আমার চোখে আপনি এক রহস্য। কলকাতায় আপনার বক্তৃতা আমি শুনেছি। মোহিত হয়ে শুনেছি। একটা বক্তৃতায় আপনি বলেছিলেন, পাপও নেই পুণ্যও নেই, আছে মানুষ ও তার কর্ম। ভগবান কিছুই তৈরি করেননি। এই পৃথিবীটা ছাড়া সবই মানুষের সৃষ্টি। মানুষই শেষ কথা। মানুষের শাসন, মানুষের ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে মানুষের বাঁচা মরা, ভালো থাকা। মানুষের স্বাধীনতা কোথায়! বাইরে দাসত্ব, ভেতরেও দাসত্ব। সেখানে তার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে তার স্বভাব। মানুষ সব জানে, নিজেকে জানে না। সেই প্রথম মানুষটা কোথায়, যার থেকে এত এত মানুষ, আসছে তো আসছেই অবিরল ধারায়। সে ভালো ছিল না খারাপ, পাপী ছিল, না পুণ্যবান। সে পুরুষ ছিল না, নারী! একজন নয় দুজন। একটি বীজের মতো। কেউ জানে না, প্রথম আদিতে কি হয়েছিল? শুধু অনুমান, কল্পনা। আমি চিরকালে হারিয়ে গেলুম। হারিয়েই থাকব রহস্যের রহস্য হয়ে।
চুপ, চুপ। অকারণে বকছ। আমাদের প্রতিদিনের বেঁচে থাকার সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। জীবন সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। চিরকালের লড়াই। দেহ হল সিংহাসন, রাজা হল একটা আমি। লক্ষ্য হল, দখল। কে কতটা আদায় করে নিতে পারে, অর্থ, বিত্ত, প্রতিপত্তি। একজনের আর-একজনকে টপকে যাওয়া। এত কথা বলার কী আছে? কত রকমের, ধরনের কামনা-বাসনা! সে তুমি চাইছ, না তোমার ইন্দ্রিয় চাইছে এসব জেনে কি হবে! একটা বিরাট কিছু আছে, অবশ্যই আছে; তা থাকে থাক। এইবার আমি একটু বসি, সেই রুটির দোকানের মেয়েটাকে ধ্যানে আনি। তার দেহটা খুব আকর্ষণীয়, দেবীমূর্তি। তার স্বভাব, কণ্ঠস্বর, আচার আচরণ আমার জানার দরকার নেই। আচ্ছা! এই মনে করি না কেন, সেই আমার রাধিকা। তুমিও তোমার সিক্তবসনা তুলসীকে ধ্যান করো। বৈষ্ণবের রাধা-কৃষ্ণ, শাক্তের শিব-শক্তি, উমা-মহেশ্বর। ধ্যানের আকর্ষণে সে আসবেই। জগতটা গুটিয়ে এতটুকু হয়ে মুক্তোর মতো ঢুকে যাবে ঝিনুকের খোলে। সমুদ্রের অতলে যেখানে কোনও ঢেউ নেই, শুধুই স্তব্ধতা, নীল প্রশান্তি স্বচ্ছতা, সেইখানে পড়ে থাকি বাকি রাতটা। তুমিও বসে থাকো শিব হয়ে তোমার উমাকে কোলে নিয়ে। ধীরে ধীরে গলতে থাকো, হয়ে যাও একটি যৌগ। কাম না থাকলে প্রেম আসবে কোথা থেকে? সে যেন বন্ধ্যার প্রসব ব্যথা! হ্যাঁ গো, আমাকে একটাই গাইবার