আপনি কী করে জানলেন?
তোমার গল্পের দাবি। এর বাইরে যাওয়ার উপায় নেই–রেললাইনের রেল।
আপনি কি বিশ্বাস করছেন না?
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা কেন আসছে? জীবনটাই তো গল্প। কিছু এখুনি ঘটে, কিছু পরে ঘটে, কিছু আবার ঘটেই না, চিন্তাতেই থেকে যায়। আমার জীবনে এমন কিছু ঘটল যার ফলে আজ আমি এখানে। তুমি কেন এখানে? ঘটনায় ঘটনায় তাহলে এমন কিছু আঘাত থাকে, যার পরিণতিটা এক। একটু কঠিন হল, তাই না? উদাহরণ-ধরো তুমি ওই পাহাড়ের মাথা থেকে খাদে পড়লে, মরে গেলে। আর আমি সাততলা বাড়ির ছাদ থেকে পড়লুম, মরে গেলুম। তাহলে অঙ্কটা কী হল–পতন ও মৃত্যু। ধাক্কা। ঠেলা। ফল এক। আমি যে কারণে সব ছেড়ে এলুম, তার মধ্যে একটা ধাক্কা ছিল। তুমি এলে, সে-ও এক ঠেলা! অদৃশ্য একটা হাত। সেই হাত বড় সাংঘাতিক! মাথা নিচু করে চোখ বুজিয়ে বসে থাকো। মাঝে মাঝে আকাশের দিকে মুখ তুলে মা, মা বলল। বলল, আমি তোমার সন্তান। যে ভাবে রাখবে, যেমন রাখবে বহুত আচ্ছা। অহংকার ঔদ্ধত্য একটা লোহার দেওয়াল। শোনো, অত হিসেব-নিকেশ, অঙ্ক কষার কী দরকার। ঝড়ের এঁটো পাতা হতে হবে। তোমার কথা আবার রাতে শুনব।
আপনার কাছে আছি, কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?
এই দেখ, একেই বলে অভিমান। অভিমানে মানুষ ক্ষুদ্র হয়ে যায়। একটা গাছের ডাল জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে এলে, কোনও অস্বস্তি বোধ করে? বহাল তবিয়তেই থাকে।
তার বোধ নেই।
কে বলেছে? প্রাণ থাকলেই বোধ থাকবে।
বোধ থাকলেই অভিমান থাকবে।
উঃ, তুমি একটা আবর্তে পড়েছ। এটা অহংকারেরই একটা রূপ। তোমার কি এমন আছে, যে এত অহংকার?
কিছুই নেই। এই দুনিয়ায় কার কি আছে? সামান্য একটা মশালের আগুনে বিরাট একটা রাজপ্রাসাদ ছাই হয়ে যেতে পারে! জরির কিংখাবের মধ্যে মহারাজার দেহ প্রাণহীন হয়ে। যেতে পারে। সোনার সিংহাসনে রাজপোশাকধারী মহারাজা কখন মারা গেছেন অমাত্যেরা জানেন না। তাঁরা “জাঁহাপনা, জাঁহাপনা” বলে আর্জি পেশ করে চলেছেন। রাজা তাকিয়ে। আছেন, কথা বলছেন না।
ওহে বৎস! তবু “আমি” মরে না। ছাই ঘাঁটলে ওই আমি টাই বেরিয়ে আসবে। একী রে? তুই এখনও মরিসনি! আমি অমর! তোমার মধ্যে আমি আছে, থাকবে। সব আমি মরে যাওয়ার পর সেই এক আমি বেঁচে থাকবে। সৃষ্টি আর বিসৃষ্টি। আমরা বসে বসে মুহূর্তের
মালা গাঁথি। একটার পর আর-একটা নতুন। আঙুলের ডগায় যাওয়া আর আসা। বাজে বকে লাভ কি? মালিকের হাতে সব! তিনি যেদিন ইস্তফা দেবেন, সেদিন কী হবে? জানি না। কেউ জানে না? তাহলে? এই যে দেখছ পথটা, দুপাশে পাহাড়ের দেওয়াল, ওপরে উঠে গেছে। একেবারে শেষে একটা ভোজনালয়। একটি পাহাড়ি পরিবার। গরম রুটি, গরম ডাল, গরম দুধ। নেশাও পাওয়া যায়। দোকানের পেছনে আশ্রয়। একা মনে হলে সেবিকা। তবে, পকেটে মাল থাকা চাই। সেটা আসবে কোথা থেকে।
আমার পূর্বপুরুষ কিছু রেখে গেছেন।
আমার পূর্ব সঞ্চয়। সে এমন কিছুনয়। এর পর?
জানি না।
কে জানে?
তাও জানি না।
আজকের দিন শেষ হয়ে এল। কাল একটা সোনালি রাঙতায় মোড়া নতুন দিন। জগতের উপহার। বিনামূল্যে। আমরা শুরু করব মাইনাস ব্যালেনসে। জীবন থেকে দিয়েছি চব্বিশটা ঘণ্টা। আর পকেটের পুঁজি খরচ করেছি ঘণ্টা বাজাবার জন্যে। চলো, এইবার চড়াই ভেঙে যাই রুটির সন্ধানে।
এখনি। আর-একটু বসুন না!
আমাদের ডেরায় আবার ফিরতে হবে তো!
সে তো একটু পথ!
কিন্তু দুর্গম। পাহাড়ে তুমি এখনও অভ্যস্ত হওনি।
হয়ে যাব। আর-একটু বসুন। কাল রাতে দুটো স্বপ্ন দেখেছি। প্রথমটা ভয়ংকর। ভোলা মালি আমার বুকে চেপে বসেছে। হাতে একটা ভোজালি।
কেন দেখলে? ওই বাড়িতে একমাত্র তার সঙ্গেই তো তোমার মনের কথা হত?
সে হত; কিন্তু আমি আমার অনুসন্ধানে জেনে ফেলেছিলুম, ওদের বাড়ির পুরনো আস্তাবলের পেছনে একটা ঢিবির তলায় একটা দেহ পোঁতা আছে। মাটি ভেদ করে গুচ্ছ গুচ্ছ চুল বেরিয়ে পড়েছে বছরের পর বছর বৃষ্টির জলে মাটি ধুয়ে যাওয়ার ফলে। ভাবছি, কোনও গাছের শেকড় না কি! উবু হয়ে বসে সাহস করে টেনে টেনে দেখছি। গা-টা কেমন যেন রি-রি করে উঠল। শেকড় তো এমন হয় না। হঠাৎ পেছন দিক থেকে কাঁধের ওপর একটা হাত এসে। পড়ল। চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ভোলা। ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। গলার স্বর অন্যরকম। এখানে কী করছ? উঠে এসো। সাপ-খোপের আড্ডা। কবেকার কোন গাছের শুকনো শেকড়ের জাল। গলার সুর পালটে মিষ্টি করে বললে, গঙ্গার দিকে বাগানে ঘোরো। এক সময় এই আস্তাবলে ঘোড়া থাকত। মাটিতে যত বাজে জিনিস ঢুকে আছে। হঠাৎ এদিকে এলে কেন। আস্তাবলের মেঝের এদিক-ওদিক ঘোড়ার পায়ের কয়েকটা নাল পড়েছিল। মাথায় খেলে গেল, নাল খুঁজতে এসেছিলুম ভোলাদা। মস্ত বড় এক তান্ত্রিক আমাকে বলেছেন, মাথার বালিশের নীচে রাখলে সব কাজে সাফল্য। আমি একটা তুলে নিলুম। ভোলা বিশ্বাস করেছে বলে মনে হল না। কিছুক্ষণ পরে দেখি ভোলা আর-একটা। লোক কোদাল দিয়ে মাটির ওপর মাটি চাপিয়ে ঢিবিটাকে উঁচু করছে। বুঝে গেলুম ব্যাপার। সুবিধে নয়। আমি একটা গোপন সূত্রের সন্ধান পেয়েছি। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিল, আর দেরি না করে পালাও। রাতে ভোলা তোমার গলা টিপে বস্তায় ভরে গঙ্গার জলে নিশুতি রাতে। ফেলে দেবে। গোটাকতক পাথর ঢুকিয়ে দেবে। একেবারে তলায় চলে যাবে। আমার কেউ। কোথাও নেই। খবর নিতে আসবে না। আমি পণ্ডিতমশাইয়ের বাড়িতে গেলুম। তিনি সব শুনে বললেন, আমার কাছে থাকো। আমার ছেলে নেই, একটি মাত্র মেয়ে, তুমিই আমার ছেলে। কারওকে কিছু না বলে আমি চলে এলুম। ভারি পবিত্র জায়গা। তুলসীর বাগান। গঙ্গার বাতাস। সারাদিন জ্ঞানের চর্চা। মনে হত, আমি কোনও তীর্থে এসেছি। পণ্ডিতমশাইয়ের মেয়ের নামও তুলসী। অসাধারণ মেয়ে। মায়ের শরীর ভালো নয়। থেকে থেকে জ্বর আসছে। বোধহয় ম্যালেরিয়া। মেয়ে সংসারটাকে মাথায় করে রেখেছে। বাড়ি নয় আশ্রম। ঝকঝকে পরিষ্কার। ছবির মতো সব গোছানো। স্বপ্নে তুলসীকে দেখলুম। তুলসীবেদিতে সন্ধ্যায় প্রদীপ রেখে গলায় আঁচল দিয়ে প্রণাম করছে। আমাকে দেখে বললে, একী দাঁড়িয়ে কেন, প্রণাম করো। প্রণাম করে উঠে দেখি কেউ কোথাও নেই, সব ফাঁকা, আমি দাঁড়িয়ে আছি একা।