শ্যামল মাথা নেড়ে বলে, সে তো বটেই। আমি ওসব লেভেল-টেভেল থেকে বলছি।। এমনিতে অ্যাপারেন্টলি দিল্লি চমৎকার শহর। অনেকে বলে লাইফ নেই, আচ্ছা নেই, অ্যাজ ইফ ওটা একটা ভাইট্যাল ব্যাপার। বাঙালি যে আড্ডা দিয়ে দিয়ে শেষ হয়ে গেল সেটা কে দেখছে?
বিশ্বরূপ ঘড়ি দেখে নিয়ে বলে, আপনি ভিতরে যান। বোধহয় এতক্ষণে আপনাদের ডিনার সার্ভ করে দিয়েছে। দেরি হলে বউদি ফের রেগে যাবেন।
ওঃ ইয়েস। নতুন করে রাগবার কিছু নেই। উনি ইন ফ্যাক্ট রেগেই আছেন।
বাথরুম ঘুরে দু’জনেই ফিরে আসে কামরায়। শীতল নিস্তব্ধতা। অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত প্রায় দশটার কাছাকাছি। দুটো ঢাকা দেওয়া ট্রে সাজানো রয়েছে টেবিলে। সিটের এক পাশে দুটো বেডরোলও সাজানো রয়েছে। মাড়োয়ারিটি বাঙ্কে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বকুল একটা বাংলা উপন্যাস পড়ার চেষ্টা করছে। মুখটা থমথমে।
গাড়িটা কি পাগল হয়ে গেল? এত জোরে যাচ্ছে কেন? শ্যামল সামান্য উদ্বেগ বোধ করল। একবার তাকাল বকুলের দিকে। ভারী অভদ্র বকুল। সে বিশ্বরূপকে ইনট্রোডিউস করে দিল, বকুল একটা হ্যালো গোছের কিছু বলল না। অত রেগে যাওয়ার কী আছে? এত ন্যাগিং হলে কি চলে?
খাবে?—বইটা রেখে বকুল ঠান্ডা গলায় বলে।
শ্যামল একটু গম্ভীর হয়ে বলে, খেতে পারি।
হাত ধুয়ে এসো। বাস্কেটে সাবান আছে।
জানি।-বলে শ্যামল একটু গুম হয়ে সাবান নিয়ে হাত ধুয়ে এল।
বিশ্বরূপ কিন্তু খাচ্ছে না। ফের জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে।
মুরগির একটা ঠ্যাং তুলে গন্ধটা শুকে নিয়ে শ্যামল বলে, আপনি কি ডিনার সেরে এসেছেন?
বিশ্বরূপ স্তিমিত গলায় বলে, হ্যাঁ।
খাওয়ার সময় শ্যামলের একটা প্যাশন কাজ করে। এতটাই করে যে সে খেতে খেতে গল্প-গাছা বা টিভি দেখা বা অন্যমনস্ক হওয়া পছন্দ করে না। সে খেতে ভীষণ ভালবাসে। ফলে পঁয়ত্রিশেই তার শরীরে বেশ মেদ জমে গেছে। পেটটায় বিশেষ রকমের। আগে তার কুকুরের মতো চিমসে-মারা পেট ছিল। বকুল আর তার মধ্যে একটা নীরবতার বলয় তৈরি হয়েছে। তাদের দাম্পত্য জীবনে এটা খুবই হয়। যখন-তখন হয় এবং আবার একসময়ে বলয়টা ভেঙেও যায়। মেয়েটা হওয়ার পর থেকেই এটা বেশি হয়েছে। মেয়েকে উপলক্ষ করে তাদের আজকাল বেশ লেগেও যায়।
শ্যামল আর বকুল যখন খাচ্ছে তখন নাঙ্গা সিটের ওপর হাতে মাথা রেখে বিশ্বরূপ একসময়ে গড়িয়ে পড়েছে। খাওয়ার ঝেকে লক্ষ করেনি শ্যামল। খেয়ে আঁচিয়ে এসে সে বকুলকে চাপা গলায় বলে, মাসিমাকে নিতে হাওড়ায় গাড়ি আসবে। একবার বলে দেখবে নাকি গাড়িটা যদি আমাদের একটু পৌঁছে দেয়!
বকুল চুপ করে থেকে রাগের গলায় বলে, তুমিও তো বলতে পারতে?
আহা, সবাই জানে আমার চেয়ে তুমি বেটার টকার।
কাজের বেলায় আমি, না!
প্লিজ! অত রাতে পৌঁছে আমরা স্ক্র্যান্ডেড হয়ে যাব। গাড়ি যখন মাসিমাকে নিতে আসছেই আমাদের ইজিলি পৌঁছে দিতে পারবে।
বকুল সামান্য থমথমে মুখে বলে, আমি পারব না। তুমি যে কেন সামান্য ব্যাপারেই এত টেনশনে ভোগো? তোমাকে নিয়েই হয়েছে মুশকিল। একটা রাত হাওড়ায় বসে থাকলে কী হয়? রাতটাও পুরো নয়। ভোর চারটে সাড়ে চারটেয় ট্যাক্সি চালু হয়ে যাবে। ম্যাক্সিমাম ঘণ্টা তিনেক বসে থাকতে হতে পারে, তাতে এমন কী অসুবিধে বলল তো!
টুকুসটার যে কষ্ট হবে।
কীসের কষ্ট? সুটকেস পেতে শুইয়ে রাখব, অঘোরে ঘুমোবে।
মুখখানা তোম্বা করে শ্যামল বলে, তা অবশ্য ঠিক।
যাও ওপরে উঠে শুয়ে পড়ো। তার আগে আমাদের বেডরোলটা পেতে দাও। কম্বলচাপা দিতে হবে, যা ঠান্ডা ছেড়েছে। ওদের একটু বলল না গো, ঠান্ডাটা একটু কমিয়ে দিতে।
বললেই কি আর দেবে?
বলেই দেখো না।
এত রাতে কি আর মেশিনের লোক জেগে বসে আছে?
তুমি সব ব্যাপারেই বড্ড ফাঁড়া কটো। ঘরের বাঘ, বাইরের বেড়াল। যাও তো, একটু হাঁকডাক করো। পুরুষ মানুষকে একটু হাঁকডাক করতে হয়। মেনিমুখো হয়ে থাকলে চলে না।
যাচ্ছি বাবা, যাচ্ছি।
এইসব ছোটখাটো প্রবলেম কখনওই মেটাতে পারে না শ্যামল। তার কপালটাই এরকম। বউ তাকে যত তাড়না করে ততই সে নার্ভাস হয়ে পড়ে, ততই গুবলেট হয়ে যায় সবকিছু। এই যেমন এখন শ্যামল করিডোর বা আশেপাশে কাউকে পেল না। মেঝেতে একটা কাপড় পেতে দু’টি লোক গুটিসুটি হয়ে ঘুমোচ্ছে। কন্ডাক্টরও জায়গায় নেই। শূন্যকে তো আর কিছু বলা যায় না। শ্যামল অগত্যা ফিরে এল।
কেউ নেই। কাকে বলব?
ইস, এত ঠান্ডায় ঠিক সর্দি লেগে যাবে টুকুসের। ওর তো ঠান্ডা একদম সহ্য হয় না।
ভাল করে কম্বলচাপা দিয়ে রাখো না। মনে করে নাও এটা শীতকাল।
শীতকালের ঠান্ডা আর এয়ারকন্ডিশনারের ঠান্ডা মোটেই এক নয়। আর্টিফিসিয়াল ঠান্ডা শরীরের পক্ষে ভীষণ খারাপ, বিশেষ করে যাদের সর্দির ধাত আছে। তোমার দ্বারা কোনও কাজ হওয়ার নয়। আমি টুকুসকে নিয়ে দাঁড়াচ্ছি, তুমি বিছানাটা তাড়াতাড়ি করে দাও।
ঠিক এই সময়ে বিষণ্ণ বিশ্বরূপ মৃদু স্বরে বলে, দাঁড়ান, আমি ঠান্ডা কমানোর ব্যবস্থা করে আসছি।
বলে উঠে গেল।
দেখলে! সবাই তোমার মতো নয়। তুমি নিজের জন্য যা পারলে না, এ ছেলেটা পর হয়েও কেমন উঠে গেল।
বিছানা পাততে পাততে শ্যামল বলে, তুমি ছেলেটার সঙ্গে কিন্তু বেশ অভদ্র ব্যবহার করেছ। আমি ইন্ট্রোডিউস করে দেওয়া সত্ত্বেও একটাও কথা বলেনি।