আঙুলে গরম লাগায় সিগারেটের শেষ অংশটা দেয়ালের উপচে পড়া অ্যাশ-ট্রেতে গুঁজে দিয়ে শ্যামল বলে, কলকাতায় আপনি কোথায় থাকেন?
কলকাতা! না, কলকাতায় আমার তেমন কোনও আস্তানা নেই। মাঝে মাঝে অফিসের কাজে আসি, হোটেলে থাকি।
আত্মীয়স্বজন?
কলকাতায় তেমন কেউ নেই। দূর-সম্পর্কের দু’-চারজন আছে।
ছেলেটা সিগারেট তেমন করে খায়নি৷ দুটো-একটা টান দিয়ে ফেলে দিল। শ্যামল আর একটা ধরিয়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল, আর চলবে?
না, থাক।
প্যাকেটটা বুকপকেটে রাখতে গিয়ে লাইটারটা টুকুস করে পড়ে গেল। ছ্যাত করে উঠল বুকটা। লাইটারটা তার দারুণ প্রিয়। এক বন্ধু হংকং থেকে এনে দিয়েছিল। একটু অসভ্য ব্যাপার আছে জিনিসটার গায়ে। চ্যাপটা ছিমছাম লাইটারটার গায়ে দুটো বিকিনি পরা সুন্দরীর ছবি। আপসাইড ডাউন করলেই বিকিনি অদৃশ্য হয়ে দু’জনেই সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে যায়। বকুল কয়েকবারই এটাকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছে, তোমার রুচিটা কী বলো তো! খুব রস পাও ন্যাংটো মেয়ের ছবি দেখে? টুকুস কিন্তু বড় হচ্ছে মনে রেখো। শ্যামল আজকাল লাইটার বকুলের সামনে পারতপক্ষে বের করে না। জনসমক্ষেও একটু লুকিয়েই রাখতে হয় জিনিসটা। কিন্তু লাইটারটা তার ভীষণ প্রিয়। খুব পাতলা, ছিমছাম, ভিতরে গ্যাস কতটা আছে তা দেখার জন্য উইন্ডো, বেশির ভাগ সময়ে এক স্ট্রোকেই জ্বলে। তাইওয়ান ফাইওয়ানের মতো দেশও আজকাল কত পারফেক্ট প্রোডাকশন করছে। উঠে আসছে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, এমনকী ইন্দোনেশিয়াও। কিন্তু ইন্ডিয়া কোথায়? এখনও ইন্ডিয়ায় ভদ্রগোছের ব্যবহারযোগ্য ইলেকট্রনিক লাইটার তৈরি হয় না, ভাবা যায়?
লাইটারটা কুড়িয়ে ট্রাউজারের গায়ে মুছে পকেটে ভরল শ্যামল।
আপনি দিল্লি-বেসড বাঙালি?
ছেলেটা মাথা নাড়ে, না।
দেন হোয়ার আর ইয়োর ফোকস? মানে আপনার নিয়ার রিলেটিভরা সব কোথায়?
ছেলেটা তার আকর্ষণীয় ঈষৎ ভাঙা কিন্তু স্বপ্নালু গলায় বলে, আমার তেমন কেউ নেই। আমি একটু লোনলি।
একদম একা?
একরকম তাই। আমি ওনলি চাইল্ড। মা-বাবা ডিসিসড।
বিয়ে করেননি?
না।
না-টা খুব কনফিডেন্স নিয়ে বলল না। একটু থেমে থেমে বলল, অনেক কথা ঠিক অফ হ্যান্ড বলা যায় না।
খুব সমবেদনার সঙ্গে শ্যামল বলে, তা তো বটেই। আই অ্যাম বিয়িং এ নোজি পার্কার। ডোন্ট মাইন্ড ব্রাদার। আপনার নামটা জানতে পারি কি?
বিশ্বরূপ।
আপনার নোজি কিন্তু একটু মেলাঙ্কলিক। তাই হঠাৎ আমার মনে হয়েছিল, কোনও মিসহ্যাপ হয়ে গেছে কি না।
মাত্র চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সি সুন্দর ছেলেটা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ বলল, অনেকের কাছে এই বেঁচে থাকাটাই একটা মিসহ্যাপ।
কামরার দরজাটা খুলে গেল। বকুল। রুষ্ট মুখ।
এই, তুমি এখানে! বাচ্চাটাকে একা ফেলে এসেছ, আচ্ছা তোক তো!
শ্যামল তাড়াতাড়ি সিচুয়েশন সামাল দিতে গিয়ে বলে, আরে, এ হল বিশ্বরূপ। এ ব্রাইট বয়। একটা আলোচনা হচ্ছিল। আমি তো টুকুনের পাশে সুটকেস খাড়া করে প্রোটেকশন দিয়ে এসেছি, দেখোনি!
বকুল ঝড়াক করে দরজাটা ছেড়ে দিয়ে ভিতরে চলে গেল রাগ করে।
ছেলেটার ব্যথাতুর মুখে একটা ক্লিষ্ট হাসি ফুটল, বউদি রাগ করবেন বলেছিলাম।
শ্যামল কাঁধ ঝাকিয়ে স্পোর্টসম্যানের মতো বলল, ম্যারেজ হ্যাজ ইটস টোল। বউ তো রাগ করার জন্যই আছে। রাগ ছাড়া অন্য মুড খুব রেয়ার। আমি সিজনড হয়ে গেছি।
ছেলেটা বেশ লম্বা। শ্যামলের চেয়েও ইঞ্চি দুয়েক। শ্যামল পাঁচ ফুট ন’ ইঞ্চি। এ প্রায় ছ’ ফুট। চেহারাটা বেশ পেটানো। দেখতে ভাল। কিন্তু মুখখানায় একেবারে ছাই মাখানো যেন। সামথিং রং। ভেরি মাচ রং।
খুব ঘুরলেন?— যেন কথা বলার ইচ্ছে নেই, তবু জোর করে বলার মতো বলল ছেলেটা।
শ্যামল সিগারেট শেষ করে বলে, আমরা প্রতি বছরই এ সময়টায় বেরোই। গতবার সাউথ ইন্ডিয়া, তার আগেরবার রাজস্থান, তারও আগে কুলু মানালি। ঘোরাঘুরি এবার বন্ধ করতে হবে। যা অবস্থা। কাশ্মীরে লাশ পড়ছে, পঞ্জাবে লাশ পড়ছে, আরও হবে। ভয় হয়, সব জায়গাতেই না বেড়ানোতে কুলুপ পড়ে যায়। আচ্ছা, আপনি কি চাকরি করেন? না কি বিজনেস? চাকরি!
ওঃ হ্যাঁ, বলছিলেন বটে অফিসের কাজে কলকাতা যাচ্ছেন। দিল্লি বেস করে থাকা খুব ভাল। সেন্ট্রাল জায়গা। কী জানি কেন মশাই, আমার দিল্লি শহরটা বেশ লাগে।
হ্যাঁ, ওপর থেকে খুবই সুন্দর।
নিচু থেকে কি অন্যরকম? নীচের দিল্লিও আছে নাকি?
সব শহরেরই থাকে। ওপর থেকে একরকম, নীচের লেভেল থেকে অন্যরকম।
তাও হয় নাকি? দুটো দিল্লি!
বিশ্বরূপ মৃদু হেসে বলে, দুটো কেন, বড় বড় শহরগুলোর ভিতরে অনেক লেভেল থাকে। যেখান থেকে যেমন দেখায় সেরকমই দেখে মানুষ। পলিটিক্যাল লেভেল, কালচারাল লেভেল, ইন্টেলেকচুয়াল লেভেল, ক্রাইম লেভেল। আপনি যেটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকবেন শহরটাকে সেই অ্যাঙ্গেল থেকেই বিচার করতে থাকবেন।
ওয়েল বিশ্বরূপ, আপনার লেভেলটা কী? পলিটিক্যাল না কালচারাল?
ক্রাইম।
অ্যাঁ! তার মানে?
আমি পুলিশে চাকরি করি।
মাই গড! আপনাকে আর যা-ই হোক, পুলিশ বলে কিছুতেই মনে হয় না। আই হ্যাভ নেভার সিন সাচ এ মেলাঙ্কলিক পুলিশম্যান। ওয়েল, ওয়েল, আই অ্যাম ড্যামড।
ক্রাইমের লেভেল থেকে দিল্লি কিন্তু ততটা সুন্দর নয়।