উলটোদিকে দু’জন গম্ভীর লোক। একজন মাড়োয়ারিই হবে বোধহয়, অন্যজন যুবক চেহারার। বাঙালি বলেই মনে হচ্ছে। চুপচাপ বসে বাইরের অন্ধকারের দিকে চেয়ে আছে। এ সি টু টায়ারে ডবল কাচ লাগানো থাকে জানালায় এবং কাচ যথেষ্ট ময়লা ও ঘোলা। দিনদুপুরেই বাইরেটা ভাল দেখা যায় না। রাতে তো কথাই নেই। তবু কিছু লোক চেয়ে থাকে। খামোখাই চেয়ে থাকে।
আপনি কি কলকাতা অবধি নাকি?
লোকটা ধীরে মুখটা ফেরাল। শ্যামল সামান্য একটু বিস্মিত হল মুখটা দেখে। খুবই বিষণ্ণ, শোকাহত চেহারা। কেউ মারা-টারা গেছে নাকি? ডেকে কথা বলে কি ভুল করল শ্যামল?
সামান্য ভাঙা এবং ধরা গলায় যুবকটি বলল, আমাকে কিছু বললেন?
সরি টু ডিস্টার্ব, না, এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম কলকাতা অবধি যাচ্ছেন কি না?
হ্যাঁ, কলকাতা। ট্রেন যা লেট চলছে, কখন যে পৌঁছবে!—বলে কথাটা ছেড়ে দিল।
ছেলেটা মৃদু স্বরে বলল, পৌঁছবে।
ওই যাঃ, বকুল তো জানেই না যে মাসিমার গাড়ি আসবে। না জানলে ম্যানেজ করবে কীভাবে? এখনই ওকে অ্যালার্ট করে দিয়ে আসা দরকার। ভেবে উঠতে যাচ্ছিল শ্যামল। হঠাৎ মনে পড়ল, আরে, তাড়া কীসের! কাল সারা দিনটা তো হাতে আছে।
আপনি কি দিল্লিতে থাকেন?
ছেলেটা ফের জানালার বাইরে চেয়ে ছিল। বিষণ্ণ সুন্দর মুখখানা ফিরিয়ে বলল, হ্যাঁ, দিল্লিতে।
ছোকরার যে একটা কিছু ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। জখমটা হয়তো একটু গুরুতরই।
সিগারেট চলে তো?
সিগারেট! হ্যাঁ, তা চলে।
কী নুইসেন্স বলুন তো! এত টাকা দিয়ে লোকে এ সি টু টায়ারে ট্রাভেল করছে, কিন্তু সিগারেট খেতে হলে করিডোরে যেতে হবে। আমি একটু বেশি স্মোক করি বলে আরও অসুবিধে হয়। অথচ সেকেন্ড ক্লাসে নো রেস্ট্রিকশন। এ সি ফার্স্ট ক্লাসেও স্মোকিং অ্যালাউড। ওনলি এইসব কম্পার্টমেন্টের জন্যই এ নিয়ম। মিনিংলেস।
বলে শ্যামল উঠে পড়ে।
ছেলেটা স্তিমিত গলায় বলে, আপনার মেয়েটা কি একা থাকবে? বউদি রাগ করবেন না তো একা রেখে গেলে? পড়ে-উড়ে গেলে—
আরে না। শি ইজ এ কোয়ায়েট চাইল্ড। তবু আপনি যখন বলছেন—
বলে শ্যামল সিটের তলা থেকে বড় সুটকেসটা বের করে সিট ঘেঁষে খাড়া করে রাখল, নাউ শি ইজ সেফ। পাশ ফিরতে গেলে পড়ে যাবে না।
কামরার ভিতরটা অনেকটাই শব্দহীন। কিন্তু করিডোরে রেল কাম ঝমাঝম শব্দে কান ফেটে যেতে চাইছে। ট্রেনটা হঠাৎ একটু বেশিই স্পিড দিল নাকি? এত দুলছে যে দাঁড়ানোই কষ্টকর। এত স্পিড তো ভাল নয় বাপু! ভারতবর্ষের রেল লাইনকে বিশ্বাস কী? কোথায় নাটবন্টু আলগা হয়ে রয়েছে কে জানে বাবা। গাড়ি যদি রেল থেকে ছিটকে মাঠে নেমে যায় এই স্পিডে, তবে দলা পাকিয়ে যেতে হবে। উইথ টুকুস। অ্যান্ড বকুল। ভাবতেই কেমন গা শিরশির করে। তার ওপর দেশে যা টেরোরিজম শুরু হয়েছে। কোথায় বোমা মেরে লাইন উড়িয়ে রেখেছে, কি লাইনে টাইম বোমা বা মাইন ফিট করে রেখেছে কে জানে!
সিগারেট ধরিয়ে শ্যামল বুক ভরে ধোঁয়া টানল। ছেলেটা অ্যামেচারিশ। সিগারেট ধরাল আনাড়ির মতো। বোধহয় চান্স স্মোকার।
ট্রেনটা কেমন দৌড়চ্ছে দেখেছেন? কোনও মানে হয় এত স্পিডে রান করার?
ছেলেটা দেয়ালে পিঠ দিয়ে চোখ বুজে ছিল। চোখ খুলে বলল, হ্যাঁ, ভাল। খুব ভাল।
আচ্ছা, কিছু মনে করবেন না, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, ইউ আর ইন এ শক। এনি মিসহ্যাপ?
ছেলেটা সিগারেটের দিকে চেয়ে ছিল। মাথা নাড়ল, না।
এসি টু টায়ার করিডোরে সর্বদাই কিছু উটকো লোক উঠে পড়ে। উবু হয়ে বসা দু’জন ময়লা জামাকাপড়ওয়ালা হ্যাভ নটস কথাবার্তা বলছে। একজন চাওয়ালা দুই বাথরুম এবং দু’ কামরার যোগাযোগের দরজার কাছে ব্যাবসা করছে। তার সামনে দু’জন হ্যাভস খদ্দের। খাবারের ট্রে হাতে রেস্টুরেন্ট কার থেকে দু’জন বেয়ারা ছিমছাম অভ্যস্ত পায়ে টাল না খেয়ে এসে ঢুকে গেল কামরায়।
কন্ডাক্টরের ফোল্ডিং সিট পেতে চশমাধারী মাঝবয়সী কালো লোকটা চার্ট দেখে কী সব মেলাচ্ছিল।
কন্ডাক্টর সাহেব, লেট কিছু মেক-আপ হবে নাকি? লোকটা মাথা তুলে অতিশয় দার্শনিকের মতো বলল, কুছ হো শকতা। কোই মালুম নেহি।
লেট তো বাড়তেও পারে।
কুছ ভি হো শকতা। ইন্ডিয়ান রেলওয়ে হ্যায় না। লেট হোনা হি ইসকা দস্তুর হ্যায়।
এত স্পষ্ট স্বীকারোক্তি শুনে শ্যামল নির্বিকার হওয়ার চেষ্টা করল।
আচ্ছা, এমনও তো হতে পারে মাসিমার সেই ভাশুরপোর বাড়িও কাঁকুড়গাছিতেই। গাড়ি মাসিমাকে বালিগঞ্জে পৌঁছে দিয়ে সেখানেই যাবে! এরকম তো হতেই পারে, তাই না? পৃথিবীতে কত অঘটনই তো ঘটে। সেই যে সে একটা সত্য ঘটনার কথা কোথায় যেন পড়েছিল, অস্ট্রেলিয়ায় জাহাজ ভিড়িয়ে কয়েকজন নাবিক ফুর্তি করতে নেমেছিল। সেখানে একটি সরল যুবতীর সঙ্গে এক নাবিকের প্রেম হল এবং তারা গির্জায় গিয়ে বিয়েও করে। ফেলল। তারপর নাবিকটি চলে গেল জাহাজে, আর তার কোনও পাত্তা নেই। মেয়েটি অপেক্ষা করে করে ধৈর্যহারা, কিন্তু বোকা মেয়েটা তার ঠিকানাও ভাল করে জানে না। শুধু জানে তার নাম জন, তার বাড়ি লন্ডনে। একদিন মেয়েটির ধৈর্যচ্যুতি ঘটল। অতি কষ্টে টাকাপয়সা জোগাড় করে সে একদিন টিকিট কেটে লন্ডনগামী জাহাজে উঠে পড়ল। লন্ডনের জাহাজঘাটায় নেমে সে হারা উদ্দেশ্যে ‘জন! জন! বলে এগোচ্ছে। কী আশ্চর্য, ঠিক সেই সময়ে জনও আসছে উলটো দিক থেকে। দু’জনেই আকুল আবেগে জড়িয়ে ধরল দু’জনকে। টুথ ইজ সামটাইমস স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন।