কিন্তু যা বলল তা মোটেই তার উদ্দিষ্ট কথা নয়। খুবই অবাক হয়ে সে শুনতে পেল যে, সে বলছে, মাসিমা, কলকাতার বাড়িটা তাহলে ডিমলিশ করে ফেলাই ঠিক করলেন?
কী করব বলো! আমরা কেউ থাকি না, অত বড় বাড়ি মেনটেন করে কে? ট্যাক্সও তো কম নয়। আমার দাদাশ্বশুর তিন ছেলের জন্য তিনটে বাড়ি করে রেখে গিয়েছিলেন, ভাশুরপোরা কবে তাদের বাড়ি ভেঙে মাল্টিস্টোরিড করে নিয়েছে। শুধু আমাদেরটাই পড়ে আছে।
কোনও আগ্রহ নেই জানবার তবু কথাটা যখন উঠে পড়েছে তখন কথার ঝোকেই শ্যামল বলল, কীরকম বন্দোবস্ত হল?
হয়নি। সেই সব কথা বলতেই কলকাতা যাওয়া। একজন প্রোমোটার গত জুন মাসে আমেরিকায় গিয়ে বেকার্সফিল্ডে আমার ছেলের বাড়িতে আমার সঙ্গে দেখা করে এসেছে। মোটামুটি ঠিক হয়েছে চার ছেলেমেয়ে আর আমার জন্য পাঁচটা বড় ফ্ল্যাট দেবে, আমার ভাইঝি আর যদুর জন্য দু’খানা ঘর।
কে থাকবে?
কে আর থাকবে। এক বিনয় যদি কলকাতায় আসে তো থাকবে। বিদেশে যারা আছে তারা কেউ ফিরবে না এ দেশে। তবে সবাই চায় কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট বা কিছু থাক। ওটা একটা সেন্টিমেন্ট। কলকাতায় আমার একটা আশ্রয় আছে, এটুকু ভেবেই যা সান্ত্বনা। দু-চার বছর পর এসে দু-চারদিন থাকবে হয়তো।
পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল বাড়ি ওঠার সব কাহিনিই প্রায় একরকম, খুব একটা ভ্যারিয়েশন নেই। এত একরকম যে, বস্তাপচা মনে হয়। কাজেই মুক্তিদেবী তথা মাসিমার গল্পেও সেই রিপ্লে। শুধু একটা ব্যাপার শ্যামলের শ্বাসরোধ করে দেয়, এরা কত বড়লোক। যিশুখ্রিস্টই কি বলেছেন কথাটা যে, ছুঁচের ফুটো দিয়ে বরং হাতি গলে যাবে, তবু কোনও ধনী ব্যক্তি কখনও স্বর্গে পৌঁছোবে না! ওয়েল ওয়েল, মাই ডিয়ার জেসাস, এর চেয়ে বড় স্বর্গ আর কোন আহাম্মক চায়? তোমার স্বর্গ তো ঝোপের পাখি ধর্মাবতার। আরও একটা কথা তোমাকে মনে করিয়ে দিই অনারেবল জেসাস, তোমার সর্বশক্তিমান গডই যদি সব কিছুর মূলে আছে, তবে এই যে কিছু বড়লোক এবং তাদের তেলা মাথায় আরও তেল দেওয়া এটাও সেই কীর্তিমান একচোখো লোকটারই কাজ। বুঝলে জেসাস স্যার, তোমার গড হল পক্ষপাতদুষ্ট রেফারি। যে দল জিতছে তাকেই ফের পেনাল্টি পাইয়ে দেওয়া ছাড়া এটা আর কী বলো তো! থাকবে না, তবু পাঁচ-পাঁচটা ফ্ল্যাট তালাবন্ধ কঁকা পড়ে থাকবে। এইজন্যই তো লোকে কমিউনিস্ট হয়।
কমিউনিস্ট লোকে আরও নানা কারণেই হয়, শ্যামলও বার কয়েক হয়েছে। এখনও যে সে কমিউনিস্ট নয় এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। কারণ সে এখন কমিউনিস্ট কি না সেটা শ্যামলও জানে না। তবে ট্রেনটা যদি আরও এক কি দুই ঘণ্টা লেট করে তবে ঘুমন্ত বাঘ জেগে উঠতে পারে।
শ্যামল একটা শ্বাস একটু ধীর ও গভীর ভাবে মোচন করে বলে, যাক মাসিমা, আপনার জন্য যে একটা গাড়ি থাকবে এটা জেনে খুব নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। আমি তো দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম, গাড়ি না এলে আপনার তো খুবই অসুবিধে হবে।
মুক্তিদেবী আত্মবিশ্বাসে ভরপুর একটা হাসি হেসে বললেন, না না, তুমি একদম চিন্তা কোরো না। গাড়ি ঠিক আসবে। যদু নিজে থাকবে স্টেশনে। ত্রিশ বছরের পুরনো লোক।
তবু একবারও বলল না, আমার তো ব্যবস্থা আছে, কিন্তু তোমার কী হবে বাবা শ্যামল। আমার গাড়িটা বরং তোমাদের পৌঁছে দিক।
বলল না। পোঁটলা পুঁটলি বাক্স বউ বাচ্চা নিয়ে চার-পাঁচ ঘণ্টা হাওড়ার উদোম প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা ছাড়া শ্যামল আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না আশু ভবিষ্যতে। কারণ দিল্লি থেকে ছেড়ে গাজিয়াবাদ পার হয়েই ট্রেনটা আবার থেমেছে। এবং অনেকক্ষণ থেমে আছে। ভোগাবে। খুব ভোগাবে। শ্যামল একটু একটু কমিউনিস্ট হয়ে উঠছে কি?
মাসিমা নিচু হয়ে তার স্যামসোনাইট সুটকেসটা সিটের তলা থেকে টেনে বের হবার চেষ্টা করেছিলেন।
দাঁড়ান মাসিমা।–বলে শ্যামল সেটা বের করে দিল। ঘ্যাম জিনিস। চব্বিশ ইঞ্চি, ষাঁড়ের রক্ত রঙা, কম্বিনেশন লকওলা স্যামসোনাইট। হার্ড টপ। এ দেশের বাজারে যদি বা পাওয়া যায় হেসে খেলে হাজার দুই টাকা দাম পড়ে যাবে।
মাসিমা সুটকেস খুলে এক প্যাকেট লবঙ্গ বের করে শ্যামলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, তোমার বউকে দিয়ো। এ দেশে শুনি লবঙ্গর খুব দাম!
লবঙ্গ!—বলে শ্যামল একটা হাঁ করে রইল। লবঙ্গ তাদের কোন কাজে লাগবে সে মোটেই বুঝতে পারছে না।
দারচিনি আর এলাচিও এনেছিলাম, সেগুলো দিল্লিতেই বিলি হয়ে গেছে। ভাল জিনিস তো এখানে পাওয়াই যায় না।
শ্যামলের একবার বলতে ইচ্ছে করল, লবঙ্গ নয় মাসিমা, আই ওয়ান্ট এ লিফট।
এই সময়ে ট্রেন ছাড়ল আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বকুল এসে দাঁড়াল, এই, তুমি একটু টুকুসের কাছে গিয়ে বোসো তো। আমি বরং মাসিমার সঙ্গে গল্প করি।
সর্বহারার অর্থহীন দৃষ্টিতে শ্যামল বকুলের দিকে চেয়ে লবঙ্গের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, লবঙ্গ!
লবঙ্গ!–বকুলের চোখ যেন ঝলমল করে উঠল, ওমা! মাসিমা দিলেন বুঝি! ইস, কী দারুণ।
বলে শ্যামলের পরিত্যক্ত জায়গায় ঝুপ করে বসে পড়ে বকুল।
দেখি মাসিমা, বিদেশ থেকে আর কী আনলেন!
এই যে দেখাচ্ছি।
বকুল যদি ম্যানেজ করতে পারে তো প্রবলেমটা ফর্সা হয়ে গেল। রাত্তিরটা ভাল ঘুম হবে তার।
টুকুস–তিন বছরের আদুরে মেয়েটা নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে, নো প্রবলেম। ঠিক এইরকম একটা বয়সে স্থির থেকে যেতে পারলে সবচেয়ে ভাল। মানুষের বয়স বাড়ে, মাথা পাকা হয়, ততই বাড়ে প্রবলেম। এই যে টুকুস এত নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে এবং দুনিয়ার সব বাচ্চাই যে নিশ্চিন্তে খায়-দায়, খেলা করে, ঘুমোয়, কোনও টেনশনে ভোগে না তার কারণ হচ্ছে ওরা টের পায় ঝামেলা ঝঞ্ঝাট, দুশ্চিন্তা পোয়ানোর জন্য ওদের বাবা, মা এবং বড়রা আছে। কিন্তু বড় হয়ে গেলে তখন আর সে সুবিধে নেই। সেইজন্যই কি লোকে ভগবান নামে একজন বড় বাবাকে খাড়া করে নিয়েছিল। যাতে ঝাট-ঝামেলাগুলো তার ঘাড়ে চাপিয়ে খানিকটা শিশু হয়ে থাকা যায়।