চোরের মতো মুখ করে শ্যামল বলে, একবার মাসিমাকে দেখে আসি।
দেখার কী আছে! মাসিমা স্মার্ট মহিলা, সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছেন। শি ক্যান লুক আফটার হারসেলফ।
একটা কার্টসি তো আছে।
শ্যামল উঠে গেল। বকুল ম্যাগাজিনের ছবি দেখতে লাগল।
মাসিমা আছেন একেবারে শেষ কিউবিকলে। অনেকটা দূর। জায়গা বদল করে একই কিউবিকলে ব্যবস্থার কথা বলেছিল শ্যামল। মাসিমা- হু ইজ এ হার্ড নাট টু ক্র্যাক–মৃদু হেসে বলেছেন, থাক গে, কী দরকার? আমার কোনও অসুবিধে নেই। কম্পার্টমেন্ট তো একই। আমি তো একা একাই দুনিয়া ঘুরে বেড়াই।
মাসিমা–অর্থাৎ বিনয়ের মা–সত্যিই বিশ্বজনীন মানুষ। তার দুই ছেলে আর এক মেয়ে ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে আছে। শুধু বিদেশ-ভীত বিনয়টাই পড়ে আছে দিল্লিতে। বার দুই বিদেশে গিয়ে দেখেছে, ফরেন তার সহ্য হওয়ার নয়। দিদি ও দাদাদের ছিছিক্কার মাথা পেতে নিয়ে সে দিল্লিতেই থানা গেড়েছে। তার জীবনের প্রবলতম উচ্চাকাঙক্ষা হল কলকাতায় স্থায়ীভাবে ফিরে আসা এবং জমিয়ে আড্ডা দেওয়া। রানীক্ষেত, নৈনিতাল, হরিদ্বার ঘুরে ফেরার পথে বিনয়ের কালকাজির বাড়িতে তিনদিন ছিল শ্যামল। তিনদিন বিনয়ের গাড়িতে আগ্রা-টাগ্রা ঘুরে, দিল্লিতে প্রভূত মার্কেটিং করে, কয়েকজন আত্মীয় বন্ধুর বাড়িতে নেমন্তন্ন খেয়ে আর আড্ডা মেরে সময়টা কেটেছে দারুণ। মাসিমা তখন ওখানে মজুত। তিনিও কলকাতায় আসবেন। স্বামীর ভিটে একবার ভিজিট করেই রওনা দেবেন সুইডেনে, মেয়ের বাড়িতে। ভিটেটা অবশ্য দেখার মতো। আয়রনসাইড রোডে বাগানঘেরা পেল্লায় বাড়ি। কেমন একটা প্যালেস-প্যালেস ভাব আছে। সেখানে থাকে এক বুড়ো কেয়ারটেকার আর মাসিমার এক নিঃসন্তান বিধবা ভাইঝি। প্রকাণ্ড বাড়িটা একরকম স্থায়ীভাবে ফাঁকা। শ্যামল মাঝে মাঝে ভাবে, যাদের আছে তাদের এত বেশি আছে কেন? কলকাতায় এক টুকরো ঘরের জন্য এত মাথা খোঁড়াখুঁড়ি আর এদের অত বড় বাড়ি অবহেলায় ফাঁকা পড়ে থাকে।
শেষ কিউবিকলে মাসিমা ছাড়া তিনজনই পুরুষ। মাসিমার পরনে সাদা ধবধবে থান, চোখে ফিতে-বাঁধা চশমা, চেহারায় সম্রমাত্মক ভাব। ছোটখাটো, ফর্সা, শান্ত চেহারার ভদ্রমহিলা। বয়স সত্তর-উত্তর হবে। ফিট। আসনপিঁড়ি হয়ে বসে ইংরিজি খবরের কাগজ দেখছিলেন।
মাসিমা, কখন যে গাড়ি কলকাতা পৌঁছবে!
বোসো।–বলে মাসিমা একটু জানালার দিকে সরে গেলেন, পাশে রাখা বিদেশি হ্যান্ডব্যাগটা সরিয়ে নিলেন।
শ্যামল বসল। ভিতরটা উচাটন। ট্রেনটা যথেষ্ট জোরে চলছে বলে তার মনে হচ্ছে না। টাইম মেক-আপ করার ইচ্ছে কি আছে এদের। যদি অন্তত আধ ঘণ্টাও মেক-আপ করতে পারত তা হলে সাড়ে নটায় পৌঁছনো যেত হাওড়ায়। উঃ, যদি একটু জোরে চালায় এরা। গাড়িটা! যদি রাস্তায় আর লেট না হয়।
টুকুস ঘুমিয়েছে বুঝি?
অ্যাঁ!—বলে চিন্তাকুল শ্যামল যেন চটকা ভেঙে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঘুমিয়ে পড়েছে।
তাই ভাবছি। নইলে একবার ঠিক আমার কাছে আসত। তিনদিনেই যা ভাব হয়ে গেছে। আমাদের।
মাসিমা—অর্থাৎ মুক্তিদেবীর ডান হাতে একখানা মস্ত হিরের আংটি। একখানা বিছেহার গলায়। আর কোনও গয়না নেই। হিরের বাজারদর শ্যামলের জানার মধ্যে পড়ে না, সোনার দর সম্পর্কে একটা আবছা ধারণা আছে মাত্র। কিন্তু তার সন্দেহ মাত্র এই দুই আইটেমেই হাজার ত্রিশ-চল্লিশ পড়ে যাবে।
ইয়ে, মাসিমা, হাওড়া থেকে অত রাতে তো আপনাকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে দেওয়া যাবে না। আমরা কি সঙ্গে যাব?
মনে মনে অপব্যয়টার একটা হিসেবও করে নেয় শ্যামল। তার ফ্ল্যাট কাঁকুড়গাছিতে। মাসিমাকে বালিগঞ্জে পৌঁছে দিয়ে কাঁকুড়গাছি যাওয়া মানে বিশ-পঁচিশ টাকা বাড়তি খরচ।
মাসিমা অবশ্য হাসি-হাসি মুখ করে বললেন, তা কেন? আমাকে পৌঁছনোর কোনও দরকার নেই তো! আমার ভাশুরপোর গাড়ি নিয়ে আমাদের কেয়ারটেকার যদু স্টেশনে থাকবে। পুরনো লোক, যত রাতই হোক ঠিক মোতায়েন থাকবে।
শ্যামল একটা শ্বাস ফেলল। ওঃ, তাই এত নিশ্চিন্ত। বড়লোকদের জন্য সব ব্যবস্থাই থাকে। যাদের ভগবান দেয় তাদের এত দেয় যে ভগবানের চক্ষুলজ্জা পর্যন্ত থাকে না। দিতেই থাকে, দিতেই থাকে। ভগবান-টগবান মানে না শ্যামল, কিন্তু রেগে গেলে, উত্তেজিত হলে সে একজন অদৃশ্য প্রতিপক্ষ হিসেবে ফর দি টাইম বিয়িং ভগবানকে খাড়া করে নেয়। তাতে নিজস্ব লজিকগুলো শানিয়ে নিতে তার সুবিধে হয়। আর এই ভদ্রমহিলা মানে সো কলড মাসিমা ইনিও তো নিজে থেকে একবার বলতে পারেন, বাবা শ্যামল, তুমি বরং আমার গাড়িতেই যেয়ো। নইলে মালপত্র বউ বাচ্চা নিয়ে মুশকিলে পড়বে। কিন্তু বলল না। এই সৌজন্যটুকু এমন কিছু সাংঘাতিক প্রত্যাশা নয়। যখন বললই না তখন শ্যামলেরই কি লজ্জার মাথা খেয়ে বলা উচিত, ইয়ে মাসিমা, আপনার খুব অসুবিধে না হলে… মানে। কাঁকুড়গাছি… কাছেই… মানে বউ-বাচ্চা-মালপত্তর… কলকাতা শহর, বুঝতেই পারছেন। লোকে তো এইভাবেই ম্যানেজ করে, না কি? বলিয়ে-কইয়ে স্মার্ট লোকেরা আরও কত কঠিন পরিস্থিতিকে শুধু বুকনি ঝেড়ে জল করে দেয়। সে এটুকু পারবে না? গলা খাঁকারি দিয়ে তৈরি হল শ্যামল। দ্বিধা সংকোচের যে কর্কটা তার গলায় আটকে গিয়ে সঠিক পরিস্থিতিতে সঠিক কথাটা কিছুতেই বলতে দেয় না সেটাকে খুলে ফেলার জন্য গলাটা আর-একবার ঝেড়ে নিয়ে সে একরকম চোখ বুজে মুখ খুলল। এবং বলেও ফেলল।