রামহরি যেমন এসেছিল তেমনই চলে যায়।
বিশু গিয়ে দাদুকে পাকড়াও করে তখন, ও দাদু, রামহরি তোমার কাছে কেন আসে?
এমনি আসে। মন চায় তাই আসে। কোথাও তো ওর শান্তি নেই।
কী বলে তোমাকে?
কী আর বলবে? কত পাপ করেছে। সেই সব কথা বলে।
পাপ কাকে বলে তা ভাল করে জানে না বিশু। সে যে পাগলুদের বাড়ির পেয়ারা চুরি করে খায় সেটা কি পাপ? সে যে একবার ফটিকের হাতে চিমটি কেটে পালিয়েছিল সে কি পাপ? বর্ষাকালে ডোবার সোনাব্যাংগুলোকে ঢিল মারা কি পাপ?
অন্ধকার ঘনিয়ে উঠলেই ভূতের হাতে চলে যায় পৃথিবী। তখন হ্যারিকেনের সামনে পড়ার বই খুলে বসে সে ভাত ফুটবার গন্ধ পায়, ডালে সম্বরা দেওয়ার শব্দ আসে। আঢ্যদের বাড়ির বুড়ো যতীনবাবুর কাশির শব্দ আসে। পড়ার বইয়ের ওপর ঝুঁকে আসে মাথা। সাঁঝরাতেই ঘুমিয়ে পড়ে বিশু।
আর তখন তার ঘুমের মধ্যে নেমে আসতে থাকে ভূত, পরি, ভগবান, আরও কত কে!… রুকুদিদির একটা ভাই হয়েছে সকালবেলায় আর বিশু খবর পেয়ে ছুটছে পথে পথে আর চিৎকার করছে, রুকুদিবির ভাই হয়েছে!… রুকুদিদির ভাই হয়েছে!… ছুটতে ছুটতে পড়ে গেল বিশু। উঠে দেখল, রামহরি একখানা মস্ত ছোরা হাতে মাঠ পেরিয়ে আসছে আস্তে আস্তে, আর ছোরাটা থেকে টপ টপ করে রক্ত ঝরে পড়ছে। তাকে দেখে রামহরি চাপা গলায় বলে, কাউকে বোলো না কিন্তু খোকাবাবু। বিশু ভয়ে আর্তস্বরে বলে ওঠে, বলব না! বলব না!… মাতাল হরিদাস ডুকরে কেঁদে ওঠে হঠাৎ, আহা রে, কলকে ফুলের গাছটা যে শুকিয়ে মরে গেল। ওফ, কত দুঃখই যে আছে দুনিয়াতে ভাই রে।… টিফিনের সময় ক্লাসঘরে বিমল তাকে ফিসফিস করে বলতে থাকে, আমাদের বাড়িতে একটা আলমারি আছে, জানিস? কখনও ভোলা হয়নি। দাদু ওটা এক রাজবাড়ি থেকে কিনেছিল। চাবি নেই বলে ভোলা যায় না। দাদু কী বলে জানিস? ওটা খুললেই নাকি পিলপিল করে হাজার হাজার দুঃখ বেরিয়ে আসবে পিঁপড়ের মতো।… ওই তো চলেছে নলিনী স্যার। নিজের বাড়ির পথ খুঁজে পাচ্ছেন না, একে ওকে জিজ্ঞেস করছেন, শোনো হে, আইচ্ছা কইতে পারো আমি কোন বাড়িটায় থাকি? আমারে চিনলা তো! আমি হইলাম গিয়া নলিনী স্যার।… দুঃখী দেবীলাল একগাদা বাসন নিয়ে বসেছে কদমতলায়। তার মুখে খুব হাসি। কাছেই বসে আছে নয়নখ্যাপা। দু’জনেই হাসছে খুব। সামনে কাঠকয়লার আগুনে লোহার উকো তাতিয়ে তুলছে দেবীলাল… ঝা বাবুদের বাড়িতে জাতা ঘুরছে… খুব ঘুরছে। কে ডাকল, বিশু! ও বিশু!
মা খেতে ডাকছে। বিশু ধড়মড় করে উঠে বসে।
০২. দিল্লি থেকেই ট্রেনটা ছেড়েছিল
॥ দুই ॥
দিল্লি থেকেই ট্রেনটা ছেড়েছিল চার ঘণ্টা দেরিতে। পরশু দিন বাংলা বন্ধ থাকায় গাড়ি সময়মতো পৌঁছোয়নি, তাই দেরি। বিকেল চারটের ট্রেন ছাড়ল রাত আটটায়। তখনই বোঝা গিয়েছিল, কপালে দুর্ভোগ আছে। এ সি টু টায়ারের আরামদায়ক নিরাপত্তায়ও কিছু লোক উদ্বেগ বোধ করছে। বিকেল দুটো নাগাদ এ সি ডিলাক্স এক্সপ্রেস হাওড়ায় পৌঁছনোর কথা। সেটা স্বাভাবিক নিয়মে। চারঘন্টা যোগ করলে দাঁড়াবে রাত দশটা। কিন্তু বিলম্বিত ট্রেনের ভাগ্যও বিড়ম্বিত বলে ভারতীয় রেলের অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী আরও দু’-তিন ঘণ্টা দেরি হতে পারে। রাত বারোটা-একটায় হাওড়ায় পৌঁছে একটিও ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না, কোথাও পৌঁছানো অসম্ভব। ভোর পর্যন্ত বসে থাকতে হবে স্টেশনে। কী গেরো।
উত্তেজনায় উদ্বেগে শ্যামল বারেবারে উঠে সিগারেট খেতে করিডোরে যাচ্ছে আর কন্ডাক্টর গার্ড এবং সহযাত্রীদের সঙ্গে কলকাতায় পৌঁছানোর সম্ভাব্য সময় নিয়ে জরুরি আলোচনা সেরে আসছে। তার সঙ্গে বউ-বাচ্চা-লটবহর।
বকুল একটা ধমক দিল, তুমি অত অস্থির হচ্ছো কেন বলো তো! এ ট্রেনে তো আরও হাজার কয়েক প্যাসেঞ্জার যাচ্ছে, না কি! তাদের যা হবে আমাদেরও তাই হবে। অত চিন্তা কীসের?
শ্যামল যথাসাধ্য শুকনো গলাকে মোলায়েম করে বলে, আহা, তুমি বুঝছ না…
খুব বুঝছি। একটুতেই তোমার অমন টেনশন হয় কেন? আর-একটাও সিগারেট খাবে কিন্তু খাবারের আগে। গত আধ ঘণ্টায় বোধহয় চারবার উঠে গেলে!
হাওড়া স্টেশনে রাত কাটানো মানে বুঝছ তো! হরিবল। টুকুসটার কত কষ্ট হবে। কিছু হবে না। গাদা গাদা বাচ্চা যাচ্ছে এই ট্রেনে। তাদেরও তো কষ্ট হবে।
আহা, আমি সকলের কথাই ভাবছি। মানে, আমাদের সকলেরই কষ্ট হবে!
বাংলা বন্ধ এর কথাটা মাথায় ছিল না, থাকলে…
থাকলে কী করতে? আজকের রিজার্ভেশন ক্যানসেল করতে? এখন পুজোর পর সকলের ফেরার রাশ, আগামী পনেরো দিনেও রিজার্ভেশন পেতে না। পনেরো দিন বসে। থাকতে দিল্লিতে? কী বুদ্ধি।
ওয়েল, আমি তোমার মতো অত স্পোর্টিং নই। এই ঝামেলা এড়াতে অন্তত প্লেনে একটা চেষ্টা করা যেত।
তোমার মাথাটা আজকাল একদম নরম্যালি কাজ করছে না। ট্রেন মাত্র চার ঘণ্টা লেট বলে প্লেনে উঠতে? টাকা এত সস্তা হয়েছে নাকি আমাদের? বছরে চারবার প্লেনের ভাড়া বাড়ে, সেটা জানো?
শ্যামল গুম হয়ে বসে রইল। টুকুস এখনও ঘুমোচ্ছে। নির্বিঘ্ন ঘুম। ট্রেন লেট হোক চাই হোক, ওর কিছু যায় আসে না। এই শিশুকালটাই ভাল, দুনিয়ার এত দিকদারি, টেনশন, ছোটখাটো অশান্তি, ভয় এসব স্পর্শই করে না।
শ্যামল আবার উঠতে যাচ্ছিল। বকুল একটা ধমক দিল, আবার কোথায় যাচ্ছ?