ওর কি কেউ নেই রে অজিত?
না, পরপর মরে গেল সবাই। কত কষ্ট করে মানুষ হয়েছে।
দুঃখী লোকেরা ভগবানের বড় আপন মানুষ হয়, জানিস তো!
বিশুর ভগবানও নাকি জগদীশপুরেই থাকেন। আর কোথাও নয়। জগদীশপুরে।
ওর ভাল হোক বাবা। কোনও চোট পায়নি তো! ভাল আছে?
অজিত আনমনে বলে, চোট হয়নি। তবে কেমন আছে কে জানে মা। কোন এনকাউন্টারে কবে খরচ হয়ে যাবে। ওর কথা বেশি ভাববেন না। দুঃখ পাবেন।
ওকে একখান গীতা দিয়েছিলাম। ওকে রোজ পড়তে বলিস।
দিল্লিগামী ট্রেনের এক চেয়ারকারে আর-একরকমের ভোর হল। বাইরে রোদে ভেসে যাচ্ছে মাঠঘাট। ধানখেত, প্রান্তর, উচ্চাবচ ভূমি পিছনে ফেলে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে রেলগাড়ি। একটি সিটে এলিয়ে পড়ে থাকা বিশ্বরূপের কাছে থেমে গেছে সব গতি। থেমে আছে সময়। হে কৃষ্ণ, আমি কেন কিছুই বুঝতে পারছি না কে আমার শত্রু, আর কেই বা আমার বন্ধু। হে কৃষ্ণ… হে কৃষ্ণ… কেন বুঝতে পারি না? কেন পারি না, কৃষ্ণ… হে কৃষ্ণ… হে কৃষ্ণ… কেন ভোরবেলা আমার আঁধার নেমে আসে… কেন হারিয়ে যায় কাগজের নৌকো, পরি, ভূত…
ব্রেকফাস্ট সাব?
ধীরে মুখখানা তোলে বিশ্বরূপ। ক্লান্তি আর ক্লান্তি।… রূপা, গেন বাঢ়া রে…
ডবল ডিমের ওমলেট, টোস্ট, হট কফি…
আর ইউ সিক?
বিশ্বরূপ মুখ ঘোরাল। চশমা পরা একজন ভদ্র মানুষ। বিশ্বরূপ মৃদু হেসে বলে, নো, থ্যাংক ইউ।
ইউ লুক সিক। আই ক্যান হেলপ ইউ। আই অ্যাম এ ডক্টর।
বিশ্বরূপ সোজা হয়ে গা ঝাড়া দিয়ে বসে, আই অ্যাম ও কে, ডক্টর।
ডাক্তারের ওপাশে জানালার ধারে এক ভদ্রমহিলা। একটু ঝুঁকে তিনি বিশ্বরূপের দিকে চেয়ে বলেন, ইউ লুক ভেরি ডিজেক্টেড। টায়ার্ড পারহ্যাপস?
এ বিট অফ দ্যাট। বাট ইটস অলরাইট।
একটু শীত করে বিশ্বরূপের।
আই অ্যাম ডক্টর মণি, অ্যান্ড দিস ইজ মাই ওয়াইফ মুকুল। উই আর বোথ ডক্টরস। লেট মি ফিল ইয়োর পালস।
বিশ্বরূপ হাতটা এগিয়ে দেয়।
মাই গড। ইউ আর রানিং এ হাই টেম্পারেচার। হিয়ার আর টু ট্যাবলেটস। টেক দেম উইথ টি।
বিনা প্রতিবাদে ট্যাবলেট দুটো খেয়ে নিল বিশ্বরূপ। তারপর ঘুমোল কিছুক্ষণ।
ইউ হ্যাভ এ মেলাঙ্কলিক ফেস।
বিশ্বরূপ চোখ খোলে। মণি পাশে নেই। বোধহয় টয়লেটে। তার পাশে মুকুল।
বিশ্বরূপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। হে কৃষ্ণ, আমি কেন আর বুঝতে পারছি না কে শত্রু কে মিত্র? কেন গুলিয়ে যাচ্ছে সব! কত দূর ছড়িয়ে দিয়েছ তোমার কুরুক্ষেত্র, কত দূর?
আপকা শুভ নাম?
বিশ্বরূপ সেন।
ইটস এ নাইস নেম। ইউ হ্যাভ এ নাইস ফেস।
থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ।
গো টু স্লিপ নাইস ম্যান। উই আর হিয়ার টু হেলপ ইউ।
বিশ্বরূপ চোখ বোজে। একদিন গুপ্তঘাতক তাকে পেয়ে যাবে। বোমা বা অটোমেটিক রাইফেল বা চপার শেষ করে দেবে তাকে। তৈরি হচ্ছে তার আততায়ী। হে কৃষ্ণ, আমি কেন কিছুতেই আর বুঝতে পারি না কিছু? এই বিষাদ, এই প্রগাঢ় ক্লান্তির অর্থ, এই বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়ার অর্থ, গৃহবধু-সন্তানের অর্থ, যশ ও উন্নতির অর্থ, আমি কিছুই আর বুঝতে পারি না কেন? হে কৃষ্ণ…