এই বিশাল রাষ্ট্রযন্ত্রে কার উত্থান, কার পতন তা কে বলবে? সে শুধু একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। নিমিত্তের ভাগী। খড়ের পুতুল। কাজটুকু শুধু করে যাওয়া। ফললাভে তার অধিকার নেই। সে মেডেল পাবে না। যে দেশে সবাই চোর সে দেশে চোর ধরা পড়লে অন্য চোরেরা তাকে জোট বেঁধে পেটায়। চোরেরাই তাকে ধরে, তার বিচার করে চোরেরা, তাকে বন্দি করে পাহারা দেয় অন্য সব চোর। এর চেয়ে হাস্যকর সিস্টেম আর কী আছে? চোরেরা আইন বানায়, চোরেরাই তা ভাঙে। বিশ্বরূপ এই সিস্টেমের দালাল, বেতনভুক খুনি। প্রতি সন্ধেবেলা তার দাদুর কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে নিজের পাপের কথা বলতে ইচ্ছে করে।
দাদু নেই। মা নেই। বাবা নেই। কেউ নেই। কেউ কোথাও নেই।
ফোনের প্রথম রিং হতেই সতর্ক তন্দ্রা ভেঙে প্রস্তুত-হাতে রিসিভার তুলে নিল। বিশ্বরূপ।
বন্দনা দূর-গলায় বলল, মিস্টার সেন?
হ্যাঁ।
জিৎ হোটেল। রুম সতেরো।
ধন্যবাদ। পার্টি কেমন চলছে?
এখনও শুরু হয়নি। লেট-নাইট পার্টি অফ ইয়ং পিপল। রাত নটায় শুরু হবে, চলবে সারা রাত। আসবেন? আমি নেমন্তন্ন করছি আপনাকে। মিউজিক, ড্যান্স, ড্রিঙ্কস, আসবেন?
বিশ্বরূপ মৃদু হাসে, নেমন্তন্ন নিলাম, তবে যেতে পারব কি না কে জানে, জীবন এত অনিশ্চিত।
গড সেভ ইউ। অপেক্ষা করব কিন্তু।
আচ্ছা। বাই।
বাই।
আর-একটা অতি সংক্ষিপ্ত ফোন করল বিশ্বরূপ। একটু অপেক্ষা করল, তারপর বেরোল।
ফটকের সামনে দাঁড়াতেই একটা ধীরগতি পেট্রল পুলিশ-ভ্যান এসে তুলে নিল তাকে। ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে চোখ বুজে রইল বিশ্বরূপ। সে জানে, বন্দনা শর্মা তার সঙ্গে তঞ্চকতা করছে না, তার দেওয়া খবর একশো ভাগই ঠিক আছে। সুরিন্দর যদি তাকে একটু নাচিয়ে থাকে তবে সুরিন্দরের দোষ নেই। এই সব ফ্যানসি সুন্দরী মেয়েকে নিয়ে কি সুরিন্দরের চলে? এরা তার কাজে লাগে, এদের কাছ থেকে মোটা টাকা আদায় হয়। প্রয়োজনে এদের প্রভাব ব্যবহার করা যায়, অসময়ে আশ্রয় পাওয়া সম্ভব হয়, এদের। উচ্চকোটির বন্ধুবান্ধবদেরও কিছু সমর্থন মেলে, এই পর্যন্ত। বিশ্বস্ত, জান-কবুল সাথিয়া তো এরা নয়। তার জন্যই সুরিন্দরের লাগে সুন্দরীর মতো মেয়েদের, যারা যে-কোনও কষ্ট স্বীকার করতে পারবে, কখনও ছেড়ে যাবে না, কখনও অবাধ্যতা প্রকাশ করবে না, কেটে ফেললেও মুখ থেকে কোনও কথা কেউ যার বের করতে পারবে না। সুন্দরীর পরিচয়টা সেই জন্যই জানা দরকার ছিল বিশ্বরূপের। পীতাম্বর মিশ্র বুঝতেও পারেননি তিনি কোন আগুন নিয়ে খেলছেন। নিজের স্ত্রী ভজনা দেবীর ওপর প্রতিশোধস্পৃহায় তিনি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। শেষ অবধি সুন্দরীর প্রভাবে হয়ে পড়েছিলেন উগ্রবাদের সমর্থক। হয়তো একটা সময়ে ষড়যন্ত্রের আঁচ পেয়ে চৈতন্যোদয় হয়েছিল তার, কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। গুনাগার অনেক দিতে হল তাকে।
ভজনা দেবী বলছিলেন, সায়নমতে পীতাম্বরের সূর্যরাশি হল বৃশ্চিক। বৃশ্চিকের জাতকেরা বুড়ো বয়সে হয় পাগল হয়ে যায়, নয়তো অপঘাতে মরে।
বিশ্বরূপের সূর্যরাশিও তাই। স্কোর্পিও বৃশ্চিক।
স্টেশনের কাছেই জিৎ হোটেল, নতুন ঝকঝকে ঝলমলে। প্রায় দুশো গজ দূরে গাড়ি থেকে নামল বিশ্বরূপ। হাতে সুটকেস।
তার পায়ে পায়ে উচ্চারিত হচ্ছে একটি শ্লোক, হতো বা প্রাপ্তসি স্বর্গং, জি বা ডোক্ষসে মহীম। তার বুকপকেটে ভজনা দেবীর দেওয়া গীতা। কিন্তু এ লড়াইতে কি হারজিত আছে?
আই ওয়ান্ট এ রুম।–রিসেপশন কাউন্টারে অকম্পিত হাত রেখে একটু ঝুঁকে বলে বিশ্বরূপ। ঠান্ডা গলায়। বাঁ দিকে মস্ত রেস্তরাঁ। অনেক লোক খাচ্ছে।
ইয়েস স্যার।— বলে বিনীত স্মার্ট সুবেশ অবাঙালি রিসেপশনিস্ট তার রুমচার্ট দেখতে দেখতে বলে, এ সি অর নন এ সি স্যার?
নন এ সি৷ ইটস অলরেডি কোল্ড ইন ধানবাদ।
ইয়েস স্যার।
একটু সময় লাগে। তারপর ঘরের চাবি হাতে আসে। হোটেল বয় তার সুটকেস তুলে নিয়ে পথ দেখিয়ে নিতে থাকে।
ঘরে এসে ভিতর থেকে দরজাটা বন্ধ করে দেয় সে। এই ফ্লোরেই কোণের দিকে সতেরো নম্বর ঘর। ঘরের আলো নিভিয়ে দেয় বিশ্বরূপ। একটু বসে থাকে চুপচাপ। হঠাৎ তার মনে পড়ল, সুরিন্দর তাকে ডাকত রূপা বলে। খেলার মাঠে ছুটতে ছুটতে চেঁচিয়ে উঠত, আরে রূপা, গেন বাঢ়া রে!
এতক্ষণে নীচের রেস্তরাঁয় অন্তত ডজন খানেক সাদা পোশাকের পুলিশ ঢুকে পড়েছে খদ্দের হয়ে। তারা সশস্ত্র, প্রস্তুত। অন্ধকারেই ঘড়ি দেখল বিশ্বরূপ। একটা পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে করিডোর দিয়ে।
বিশ্বরূপ উঠে দরজা চুল-পরিমাণ ফাঁক করে দেখল। ঘর থেকে বেরোনোর আগে সুরিন্দরের লোক আগে দেখে নেবে, রাস্তা পরিষ্কার কি না। এ সেই অগ্রদূত, লম্বা, ফিট, চটপটে।
দরজাটা আর-একটু ফাঁক করে দাঁড়ায় বিশ্বরূপ। লোকটা সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে চারদিকটা দেখে নেয়। তারপর নেমে যেতে থাকে।
সতেরো নম্বরের দরজা ধীরে খুলে গেল। বুকটা হঠাৎ খাঁ খাঁ করে ওঠে বিশ্বরূপের। অতীত থেকে একটা কণ্ঠস্বর চেঁচিয়ে উঠল কি ‘রূপা, গেন বাঢ়া রে…’?
সুরিন্দর বেরিয়ে এল। ফেটে পড়ছে স্বাস্থ্য। ফেটে পড়ছে আত্মবিশ্বাস। ফেটে পড়ছে অন্তর্নিহিত ক্রোধ।
নিঃশব্দে দরজা খুলে মুখোমুখি করিডোরে দাঁড়াল বিশ্বরূপ।
বিদ্যুৎস্পর্শে কেঁপে গেল সুরিন্দর। তার ক্রুর চোখ স্থাপিত হল বিশ্বরূপের চোখে। কে জানে কেন হঠাৎ কোমল হয়ে এল সেই চোখ।