হিন্দি আমার দ্বিতীয় মাতৃভাষা। কিন্তু গীতার দরকার নেই।
আছে। এই মায়ের এ কথাটা শুনো। সঙ্গে রেখো।
বাইরের ঘরেই বুক-শেলফ। ভজনা দেবী উঠে ছোট্ট একখানা পকেট গীতা এনে বিশ্বরূপের হাতে দিয়ে বললেন, এটা তোমাকে আমার উপহার।
তা হলে আজ চলি।— গীতাটা বুকপকেটে রেখে বিশ্বরূপ বলে।
এসো বাবা, জয়ী হও।
বিশ্বরূপ একটু হাসে, আমার জয়ী হওয়া মানে কিন্তু সুরিন্দরের মৃত্যু।
ভজনা দেবী সামান্য শিহরিত হয়ে চোখ বুজলেন।
চোখ বুজে থেকেই ভজনা দেবী গাঢ় স্বরে বললেন, কত মারবে তুমি? মেরে মেরে কি শেষ করতে পারবে ওদের? একজন মরছে তো দশজন দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
আপনি তো গীতা মানেন। যা ঘটবার তা ঘটেই আছে। আমি নিমিত্ত মাত্র।
অস্ফুট কণ্ঠে ভজনা দেবী বললেন, ভুল হচ্ছে। কোথাও বড় ভুল হচ্ছে আমাদের।
তাই হবে হয়তো। কে জানে! দুর্বল পুরুষকার, দৈব বলবান।
তারা যখন ঘর থেকে বেরিয়ে এল তখনও নিথর হয়ে চোখ বুজে বসে আছেন ভজনা দেবী।
ফ্যাক্স মেশিনে মিঠিয়ার ছবি পাঠানো হয়েছিল দিল্লিতে। পরদিনই জবাব এল, নাম সুন্দরী। পদবি নেই। দেহাতি মেয়ে, তবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ধানবাদে একটা ঠেক আছে। বন্দনা শর্মা হয়তো কিছু জানে। কিন্তু বন্দনা বড়লোকের মেয়ে, প্রভাবশালী। হ্যান্ডল উইথ এক্সট্রিম কেয়ার…
দু’দিন বাদে এক সন্ধ্যায় ধানবাদের এক অফিসার্স ক্লাবে একটি সুন্দরী মেয়ে বিলিয়ার্ড খেলছিল। আচমকাই টেবিলের ওপর একটা অচেনা ছায়া এসে পড়ল।
হু আর ইউ?
দি ল!
গো টু হেল।
উই আর ইন হেল ম্যাডাম।
বন্দনা নির্বাক মুখে বিষাদগ্রস্ত মুখখানার দিকে চেয়ে রইল। এত স্পর্ধা সে কারও দেখেনি। কিন্তু সে বুদ্ধিমতী। লোকটার পিছনে সে তিন-চারজন লোককে দেখতে পেল, যাদের এখানে দেখার কথাই নয়। সে জানে, স্পর্ধার কাছে কখনও কখনও নত হতে হয়।
বন্দনা মুখ নামিয়ে নিল।
বিশ্বরূপ ইংরিজিতে বলল, আমি খুব বেশি সময় নেব না। কিন্তু একটু নিরিবিলিতে কথা বলতে চাই।
বন্দনা ঈষৎ রক্তাভ মুখে বলে, বাইরে আমার গাড়ি আছে।
চলুন।
ক্লাবের চমৎকার পার্কিং লটে একখানা নতুন মারুতি দাঁড়ানো। সবুজ রঙের ওপর ফ্লাডলাইট পিছলে যাচ্ছে। ভিতরে ঢুকে বন্দনা ইঞ্জিন আর এয়ারকন্ডিশনার চালিয়ে দিল।
নাউ শুট, হি-ম্যান।
বিশ্বরূপ তার ঘুম-ঘুম ঠান্ডা গলায় ইংরিজিতে বলে, আপনি যে কোনওরকম চেঁচামেচি রাগারাগি বা জোর জবরদস্তি না করে লক্ষ্মী মেয়ের মতো আমার সঙ্গে চলে এলেন তার জন্য ধন্যবাদ।
মোটেই তা নয়, মিস্টার সুপারম্যান। আমি অতটা সহজ লোক নই। আপনার সঙ্গে চার পাঁচজন প্লেনড্রেস পুলিশ অফিসার ছিল, তাদের সবাইকে আমি চিনি। ডি এস পি চৌধুরী সাহেবকে আমি কাকা বলে ডাকি, উনি চোখ টিপে ইশারা করায় আমি রেজিস্ট করিনি। বুঝলেন, মিস্টার জিরো জিরো সেভেন? এখন দয়া করে বলুন তো ক্লাবে এসে হামলা করার মতো এমন কী জরুরি ব্যাপার।
বিশ্বরূপ ক্লান্ত গলায় বলে, ক্লাবে না এলে আপনাকে আজ ধরা যেত না। আজ রাতে আপনার বাড়িতে বিরাট পার্টি আছে।
আপনি চালাক হলে সেই পার্টিতেই কৌশলে ঢুকে যেতে পারতেন। সিন ক্রিয়েট করতে হত না।
আমি আজ রাতেই ধানবাদ ছেড়ে যাব মিস শর্মা। আমার হাতে সময় ছিল না।
একটা ফোটোগ্রাফ বের করে বন্দনার হাতে দিয়ে বিশ্বরূপ বলে, দেখুন তো একে চেনেন কি না?
বন্দনা বাতিটা জ্বেলে এক পলক দেখেই বলল, সুন্দরী।
আমরা এর ব্যাকগ্রাউন্ড জানতে চাই।
সেটা আমি আপনাকে জানাব কেন? আমার কী দায়?
সামনের দিকে অর্থহীন দৃষ্টিতে চেয়ে আনমনে স্বগতোক্তির মতো মৃদু স্বরে বিশ্বরূপ বলে, আপনার কোনও দায় নেই মিস শর্মা।
বন্দনা শ্লেষ মেশানো গলায় বলে, নাউ মে আই গো ব্যাক টু মাই গেম, মিস্টার সেক্সঅ্যাপিল?
তেমনি আনমনে বিশ্বরূপ স্বগতোক্তির মতো করে বলে, গেম মিস শর্মা?
চাপা তীব্র গলায় বন্দনা বলে, মিস্টার বিশ্বরূপ সেন, উইল ইউ প্লিজ গেট আউট অফ মাই হেয়ার নাউ?
বিশ্বরূপ তার ক্লান্ত বিষণ্ণ চোখ দুখানা ধীরে ফেরাল বন্দনার মুখের ওপর, আপনি আমার নাম জানেন। জানার কথা নয় কিন্তু।
বন্দনা বিষ-হাসি হেসে বলে, আই হেট ইউ স্মার্ট আলেক। আই হেট ইয়োর গাটস।
কথাটা যেন শুনতেই পায়নি এমন নির্বিকারভাবে বিশ্বরূপ বলে, উই কুড টক অ্যাবাউট গেমস। হোয়াট ইজ ইয়োর গেম মিস শর্মা?
সেটা আমি আপনাকে বলব কেন? আপনি আপনার খেলা খেলবেন, আমি আমার খেলা খেলব।
বন্দনার গলার ঝঝ এবং তীব্র রাগ বা ঘেন্না স্পর্শও করল না বিশ্বরূপকে। আপনমনে মাথা নেড়ে সে বিড়বিড় করে বলল, ইট ওয়াজ নট সুরিন্দরস গেম আইদার। সুরিন্দর নেভার কিলড এ উয়োম্যান।
ঝাঁঝালো মার্কিন ইংরিজিতে বন্দনা বলে, কী সব যা-তা বলছেন! প্লিজ! আমি আর সময় দিতে পারছি না।
বিশ্বরূপ একটু হাসে, সময়টা কাকে দেবেন মিস শর্মা? যখন হাতে অনেক সময় পাবেন, কিন্তু বিলিয়ার্ড টেবল থাকবে না, ক্লাব থাকবে না, পার্টি থাকবে না, গাড়ি থাকবে না, বন্ধু থাকবে না, এমনকী এক চিলতে আকাশ বা সামান্য ঘাসজমিটুকুও থাকবে না, থাকবে শুধু গরাদের অবরোধ, তখন সময়টা কাকে দেবেন?
বন্দনা চিড়চিড়িয়ে উঠতে যাচ্ছিল।
বিশ্বরূপ শান্ত গলায় বলে, অযথা আনপ্রফিটেবল রাগ করতে নেই। ইউ আর নট বিয়িং লজিক্যাল।