বিশু তার কাছে গিয়ে বসে বসে দেখে, নয়নের মুখে সব সময়ে একটা খুশিয়াল ভাব। হাসি উপচে পড়ছে মুখে। মাথার ওপর চাল নেই, পেটে ভাতের জোগাড় নেই, ছেড়া ট্যানা ছাড়া পোশাক নেই, মা নেই, কেউ আদর করে না। তবু এত খুশি কেন নয়ন? সব সময়ে আনন্দে ডগমগ করছে। বৃষ্টিতে হাপুস হয়ে ভেজে, রোদে পোড়ে, ধুলোয় পড়ে থাকে। নয়নের কাছে বসে বসে বিশুর মনটা ভাল হয়ে যায়।
ও নয়নদা, বৃষ্টি পড়লে হাটখোলার চালের নীচে যেতে পারো না?
যাব কেন? এটা যে আমার বাড়ি।
দূর। গাছতলা বুঝি কারও বাড়ি হয়?
চুপ! কিংটু কাসিং। ডিগ ডিগ ডিগ ক্যালেন্ডারিং। কেলেটারিং, ল্যাকাভুট, ফিনিশ…
ওটা কি ইংরিজি?
ইয়েস।
বিশু হি হি করে হাসে। এটা নাকি ইংরিজি!
ভুটকোরাস! ভুটকোরাস! তেজাং গোলি।
এর মানে কী নয়নদা?
খ্যাট খ্যাট খ্যাট টেলারিং। ঝা বাবুদের মেলা কিকসুং আছে, না রে? খুব গ্যালটারিং ব্যাপার।
তুমি এমন ইংরিজি শিখলে কোথায় নয়নদা?
ইংলিশ ল্যান্ড। লন্ডন। মেমসাহেবরা কাপড় তুলে নাচে, জানিস? চিনেরা ব্যাং ভাজা খায়। আলুসেদ্ধ আর মিল্ক। কার্পেটিং।
কখনও কেউ একটা জামা দেয়। কেউ একটু ফেলে-দেওয়া খাবার। বাচ্চারা ঢিলও মারে। নয়নখ্যাপা কিছু গায়ে মাখে না। দিব্যি আছে।
ঝা বাবুদের বাড়িতে এলেই বিশুর মন ভাল হয়ে যায়। খুব উচু দেয়ালে ঘেরা মস্ত জায়গা নিয়ে ঝা বাবুদের বাড়ি। কত গাছপালা, আর কী সুন্দর ছায়া আর রোদ এখানে। সকাল থেকেই ঝা বাবুদের বাড়ি বোজ সরগরম। হুলুস্থুল সব কাণ্ড হচ্ছে সেখানে। কোথাও মোষের দুধ দোয়ানো হচ্ছে, কোথাও উদুখলে আর হামানদিস্তায় গুড়ো হচ্ছে মশলা, জাতীয় ভাঙা হচ্ছে ডাল, কোথাও তৈরি হচ্ছে পাপড়ের নেছি, কোথাও বা বানানো হচ্ছে হাজারও রকমের আচার। তিনটে দেহাতি চাকর, তিনজন দেহাতি কাজের মেয়ে আর ঝা বাবুদের বাড়ির মোটা মোটা আহ্লাদী চেহারার রুপোর গয়নাপরা ঘোমটা দেওয়া বউ-ঝিরা দিন-রাত শুধু কাজ করছে। মোষের ডাক, কুকুরের চিৎকার, মানুষের কথাবার্তায় বাড়িটা সব সময় ডগমগ করছে যেন। এ যেন উৎসবের বাড়ি।
গঞ্জের বাজারে কিষুণ ঝার মস্ত পাইকারি দোকান। কাছাকাছি যত হাটবাজার আছে সব জায়গার দোকানদাররা মাল কিনতে ঝা বাবুদের দোকানে ভিড় করে। লাখো টাকার কারবার। বাবার সঙ্গে একবার সেই দোকানে গিয়েছিল বিশু। বেশি দূর নয়। মরা খাল পেরিয়ে হবিবগঞ্জ বাঁয়ে ফেলে মাইলখানেক হাঁটলেই গঞ্জের বাজার। বাজারের মাঝখানে একটা পুরনো দালানে মস্ত দোকান। সেই দোকানের ভিতরে ঢুকলেই মশলা, হিং, পাঁপড়, আটা, বস্তা, ধুলো সব কিছু মেশানো একটা ভারী অদ্ভুত গন্ধ আসে নাকে। ইচ্ছে করে, অনেকক্ষণ দোকানটায় বসে থাকে। সেখানে শুধু বিকিকিনি আর বিকিকিনি। বড় ভাল লেগেছিল বিশুর। ঝা বাবুদের দোকানে বা বাড়িতে সব জায়গায় কেবল কাজ আর আনন্দ।
বিশু মাঝে মাঝে বিমলকে জিজ্ঞেস করে, তোদের কোনও দুঃখ নেই, না রে?
কিষুণ ঝা-র নাতি বিমল বিশুর সঙ্গে এক ক্লাসে পড়ে। খুব গবেট। তার লেখাপড়ায় মাথা না থাকলে কী হবে, ব্যাবসায় নাকি খুব মাথা। বিশুর প্রশ্ন শুনে সে কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে ভেবে বলল, নেই কি আর! খুঁজলে ঠিক পাওয়া যাবে।
বিমল তাকে একবার এক গেলাস গরম মোষের দুধ খাইয়েছিল। বিশুর সহ্য হয়নি। পরদিন পেট ছেড়ে দিয়েছিল।
দাদুর কাছে গেলেই হত্তুকির পবিত্র একটা গন্ধ পাওয়া যায়। দাদু তার মাথায় আঙুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে, টাকা থাকলেই যে দুঃখ থাকে না তা কিন্তু নয়। কত পয়সাওলা লোকেরও কত জ্বলুনি থাকে। আসল কথা হল মন। মনটাকে যেমনসই করবে তেমনই থাকবে। মানুষ তো কেবলই চায়। এটা চায়, ওটা চায়, সেটা চায়। ওই থেকেই মনটা বিগড়োয়। চাওয়ার ভাবটা রাখতে নেই।
দাদু হচ্ছে বিশুর বুড়ি। ঘুরতে ঘুরতে খেলতে খেলতে এক-একবার করে এসে, বুড়ি ছুঁয়ে যায়। ভয় পেলে, ব্যথা পেলে, রাগ হলে সে ছুটে চলে আসে দাদুর কাছে। তা তার দাদু হরপ্রসন্ন তপাদার আরও অনেকেরই বুড়ি। পুজোপাঠ, যজমানি, কথকতা, কীর্তনের জন্যই শুধু নয়, লোকে বেকায়দায় পড়লে পরামর্শ নিতে আসে, মামলা-মোকদ্দমার মিটমাট করাতে, ঝগড়া-কাজিয়া-বখেরা নিয়েও আসে। তবে তার দাদুর কাছে যে-লোকটা এলে বিশু সবচেয়ে ভয় পায় সে হল খুনে রামহরি।
কালীবাড়ির বড় পুজোয় মানসিকে অন্তত ত্রিশ-চল্লিশটা পাঁঠা বলি হতে আসে। রামহরি ঝপাঝপ সেগুলো কেটে রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়। লোকে বলে, পাঠা তো পাঠা, রামহরি যে কত মানুষ কেটেছে তার হিসেব নেই। কী দু’খানা চোখ! বাপ রে! এমন পাগুলে দৃষ্টিতে তাকায় যে রক্ত জল হয়ে যায় মানুষের।
মাঝে মাঝে ভরসন্ধেবেলা, যখন চারদিকে ভুতুড়ে আঁধার কেঁপে আসে ডানা মেলে, বাড়িতে বাড়িতে বিপদ-সংকেতের মতো শাঁখ বাজতে থাকে, তখন নিঃশব্দে একটি ছায়ার মতো আসে রামহরি। দাওয়ায় জলচৌকিতে বসে সেই সময়টায় দাদু নীরবে ঠাকুরের নাম করে। একটু দূরে উবু হয়ে বসে থাকে রামহরি। চুপচাপ। অন্ধকারে তখন তাকে মানুষ বলে মনেই হয় না।
দাদুর নামকরা শেষ হলে রামহরি কী যেন ফিসফিস করে বলে। অনেকক্ষণ ধরে বলে। তারপর দাদু একসময়ে নরম গলায় বলে, আজ যা। আবার আসিস।