হতে পারে, আউট অব জেলাসি। আপনার কাছে কার কার যাতায়াত সে বিষয়েও হয়তো কৌতূহল ছিল।
তুমি কি বলতে চাও উনি আমাকে সন্দেহ করতেন? বিশ্বরূপ একটু চুপ করে থেকে বলে, সন্দেহ নানারকম আছে। উনি হয়তো আপনার নৈতিক চরিত্রে সন্দেহ করতেন না। কিন্তু পলিটিকসের লোকদের আরও নানা সন্দেহ থাকে। উনি হয়তো সন্দেহ করতেন যে, আপনি লোকের কাছে ওঁর কুৎসা রটান এবং ওঁর পলিটিক্যাল কেরিয়ারের ক্ষতি করার চেষ্টা করেন।
সেটা তো অন্য কথা।
সেটাই কথা। আপনিই অন্যরকম ভয় পাচ্ছেন।
ভজনা দেবী একটা নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলে বললেন, বাঁচালে বাবা। মরার আগে যে অন্তত চরিত্রের দোষের কথা শুনে যেতে হচ্ছে না এটা মস্ত কথা। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।
দোষটা আমারই। কিছু মনে করবেন না। কিন্তু আমাদের প্রবলেমটা রয়েই গেল। তা হল মিঠিয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড।
আমি জানলে তোমাকে সাহায্য করতাম।
একটু মনে করে দেখবেন যে কখনও তার দেশ বা গ্রামের কথা আপনাকে বলেছিল কি! কথাচ্ছলেও তো মানুষ কত কথা বলে!
ভজনা দেবী মাথা নাড়লেন, না বাবা, তার সঙ্গে ওসব কথা কিছু হয়নি। লালাজির লোক বলে আমি কখনও কিছু জিজ্ঞেসও করিনি। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি মিরচি বা মিঠিয়াকে নিয়ে খুব চিন্তিত।
হ্যাঁ। মিঠিয়াই হয়তো মিশ্রজির নিয়তি। তাকে বিয়ে করার আগে অবধি মিশ্রজি সন্ত্রাসবাদ নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। বিয়ের পর উনি এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। আপনি বোধহয় জানেন না যে, মিশ্রজি একটা এ কে ফটি সেভেন রাইফেলও জোগাড় করেছিলেন।
জানি বাবা, অজিত বলেছে। কিন্তু তুমি ভুলে যাচ্ছো বাবা, সন্ত্রাসবাদীরা মিঠিয়াকেও মেরেছে।
ক্লান্ত স্বরে বিশ্বরূপ বলে, আমি কিছুই সহজে ভুলি না।
তুমি খুব এফিসিয়েন্ট অফিসার, তাই না বাবা?
হঠাৎ এ কথা কেন বলছেন?
অন্য পুলিশদের মতো তুমি কাঠ-কাঠ নও, কড়া কথাও বলতে চাও না। সুরিন্দরের সঙ্গে পাল্লা নিতে তুমি একা এসেছ, তাতেই বুঝতে পারছি সরকার তোমার ওপর ভরসা করেন।
মাথা নেড়ে বিশ্বরূপ বলে, কথাটা ঠিক নয়।
অজিত তোমার কথা আগে কখনও বলেনি। তোমরা কি ছেলেবেলার বন্ধু?
হ্যাঁ, বনগাঁর কাছে একটা গ্রামে আমরা থাকতাম। আমরা খুব গরিব ছিলাম। অজিতরাও।
গাঁয়ে কে আছে?
কেউ নেই। আমি বড় হয়ে কখনও সেখানে যাইনি।
কেন যাওনি বাবা?
অজিত হাসল, ও মনে করে গাঁয়ে গেলে ছেলেবেলার মুখগুলি সব হারিয়ে যাবে। ও ছেলেবেলাটাকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়।
এ তো অদ্ভুত কথা!
মা, ও যে কত অদ্ভুত তা আপনি জানেন না। হার্ডকোর টেররিস্ট সুরিন্দর একসময়ে ওর দারুণ বন্ধু ছিল। জিগির দোস্ত। দু’জনে এক টিমে হকি খেলত।
বলো কী? একটা খুনির সঙ্গে।
তখন সুরিন্দর খুনি ছিল না, টেররিস্টও নয়। কাকার সঙ্গে ব্যাবসা করতে কানাডা গেল। কিছুদিন বাদেই ফিরে এল টেররিস্ট হয়ে। বিশ্বরূপের আরও হিস্টরি আছে মা, তবে সেগুলো বলা যাবে না। ও রিটায়ার করার পরও যদি আমি বেঁচে থাকি তবে ওর ওপর একটা স্টোরি লিখব। তখন দেখবেন।
বিশ্বরূপ উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, সন্ত্রাসবাদীরা অনেক সময়ে নিজের লোককেও মারে বিপদ বুঝলে। মিঠিয়ার মৃত্যুটা সেরকমই কিছু। তবে আমাদের ওর ব্যাকগ্রাউন্ডটা দরকার।
হঠাৎ ভজনা দেবী মুখ তুলে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন, সুরিন্দরকে পেলে তুমি কী করবে বাবা?
বিশ্বরূপ চুপ করে রইল।
মারবে তো! অজিত আমাকে বলছিল, তাকে সরকারের চাই-ই, ডেড অর অ্যালাইভ। কিন্তু জ্যান্ত অবস্থায় তাকে ধরা অসম্ভব। তাই না?
বিশ্বরূপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, এ প্রশ্নের কি জবাব হয়?
ভজনা দেবী একটু ভেজা গলায় বলেন, সে তোমার বন্ধু ছিল, তোমাদের ভালবাসা ছিল। এটা খুব খারাপ সময় বাবা, এ যুগে ভালবাসা বড্ড তাড়াতাড়ি মরে যায়। তোমার হাতটা একটু আমাকে দেখাবে?
বিশ্বরূপ অবাক হয়ে বলে, হাত!
ভজনা দেবী হাসলেন, আমার কাছে যে-কেউ যে-কোনও কাজেই আসুক, সকলেই একবার হাত বা কোষ্ঠী দেখিয়ে নিয়ে যায়। সত্যি হোক মিথ্যে হোক, সকলেরই নিজের ভবিষ্যৎ জানার কৌতূহল আছে। এটা মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতা। তুমি মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রমের একজন। তোমার কোনও কৌতূহল নেই?
বিশ্বরূপ একটু যেন লজ্জা পেয়ে বলে, ভবিষ্যৎ জানবার কিছু নেই আমার।
এইটুকু বয়সেই তোমার মুখখানা ভারী মলিন আর হতাশ কেন বাবা?
আমার মুখটাই ওরকম।
তোমার হাতটা আমি দেখতে চাই। তোমার কৌতূহল না থাকতে পারে, আমার আছে। লাজুক একটু হাসি হেসে বিশ্বরূপ তার ডান হাতখানা কুণ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে দিল। ভজনা দেবী হাতের কাছেই একটা সুইচ টিপে একটা ছোট স্পটলাইট জ্বাললেন। একখানা ভারী আতস কাচ দিয়ে হাতখানা দেখলেন মন দিয়ে। প্রথমে ডান, পরে বাঁ হাতও।
দেহে মনে তুমি খুব শক্তিমান মানুষ।
পুলিশে চাকরি করি বলে বলছেন?
তা কেন? তুমি যেরকম তোমার হাতও সেই রকমই বলবে।
ভজনা দেবী আরও কিছুক্ষণ হাত দেখে চোখ বুজে একটু চুপ করে থাকলেন। তারপর। ফের সেই অদ্ভুত প্রশ্নটা করলেন, তুমি সুরিন্দরকে মারবে?
বিশ্বরূপ গভীর বিষাদগ্রস্ত গলায় বলে, মারব না মরব তা তো জানি না। এ হল “জয়হীন চেষ্টার সংগীত”। আমাদের শুধু চেষ্টা আছে। ফল জানি না।
এ তো গীতার কথা। পড়েছ? পড়েছি। বারবার পোডড়া। তোমার যা জীবন, গীতা সবসময়ে তোমার পকেটে থাকা উচিত। দাঁড়াও, আমার কাছে একটা ছোট্ট গীতা আছে তোমাকে দিই। দেবনাগরী তো পড়তেই পারো।