ঘরটা একটু অন্ধকার। একটা স্ট্যান্ডের ওপর শেড দেওয়া একটা মাত্র আলো। ভজনা দেবীর মুখ দেখা যাচ্ছে না। সাদা থানের ঘোমটাটা আজ বোধহয় উনি একটু বেশিই টেনে দিয়েছেন কপালের ওপর। একটা ভাগলপুরি সুতির চাদরে গা ঢাকা। পাটনায় একটু শীত পড়ে গেছে। আজ ভজনা দেবী কোনও মক্কেল নেননি। তার মুখোমুখি লম্বা সোফায় পাশাপাশি অজিত আর বিশ্বরূপ।
ঈষৎ ভাঙা ধীর গলায় চোস্ত হিন্দিতে বিশ্বরূপ বলে, ওঁর ওই রিসার্চ কি আপনি পছন্দ করতেন না?
তা কেন? যে লোকটা বুড়ো বয়সেও নিজেকে ভাঙচুর করে ফের গড়তে চাইছে সে তো জ্যান্ত লোক। মিশ্রজিকে বার্ধক্য স্পর্শও করেনি। না, তার বাইরের জীবন আমাকে কখনও ডিস্টার্ব করেনি।
আপনাদের ডিভোর্স হয় বেশ পরিণত বয়সেই, সাধারণত যে বয়সে স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি আমরা বড় একটা দেখতে পাই না।
খুব ঠিক কথা। তবে আইনের ছাড়াছাড়ি হওয়ার অনেক আগেই মিশ্রজির সঙ্গে আমার আত্মার বন্ধন ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তুমি নিশ্চয়ই সেসব ব্যাপার জানতে চাইবে না!
আমি শুধু জানতে চাই, মিশ্রজি কি অত্যাচারী পুরুষ ছিলেন!
সব পুরুষই খানিকটা অত্যাচারী। মিশ্ৰজিকে একা দোষ দিয়ে লাভ কী? মেয়েরা তা মেনে নিয়েই স্বামীর ঘর করে। আমার বিয়ে হয় আট বছর বয়সে, আর গাওনা হয় যখন আমার বয়স আঠারো। এই আট থেকে আঠারো বছর বয়স অবধি আমাকে শেখানো হয়েছিল কী করে স্বামীর মনোরঞ্জন করে চলতে হবে, রাগী-খেয়ালি বাইরের কাজে ব্যস্ত ভি আই পি স্বামীকে কী রকম করে তোয়াজ করতে হবে। তোমরা তো জানোই মিশ্রজি ছাত্রজীবনেই ভি আই পি হয়ে গিয়েছিলেন আন্দোলন করে আর জেল খেটে, গাঁধীবাবার সঙ্গেও তার কানেকশন ছিল।
আমরা মিশ্রজির ব্যাকগ্রাউন্ড জানি মাতাজি।
মাতাজি! না, তুমি আমাকে মাতাজি বলে ডেকো না। অজিতের মতো তুমিও মা ডেকো। আজকাল অনেকে আমাকে গুরু বানিয়ে ফেলেছে, তাই মাতাজি ডাকটা চাউর হয়ে যাচ্ছে। পাঁচজনে ডাকুক, আমি তা ঠেকাতে পারব না। কিন্তু তোমরা ডেকো না।
মিজির সঙ্গে আপনার কোথাও প্রফেশন্যাল জেলাসি ছিল কি? শুনেছি উনি জ্যোতিষ টোতিষ মানতেন না।
ওঁর সঙ্গে আমার অনেক বিষয়েই নটখট ছিল। জ্যোতিষও তার মধ্যে একটা। তবে বাবা তোমাকে বলি জ্যোতিষ কিন্তু আমি টাকা রোজগারের জন্য করি না। আমার আগ্রহ ছিল, তাই প্রথম নিজে নিজে শিখেছিলাম। টের পেতাম, আমি অনেক অদেখা জিনিস অনুমান করতে পারি, অনেক অজানা কথা টের পাই। বিদ্যেটা আমি ভালবাসি। তোমরা হয়তো বিশ্বাস করো না, না করাই স্বাভাবিক, কিন্তু আমার কাছে এটা লোক-ঠকানোর কায়দা নয়। অজিতকে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো, ও আমাকে অনেকটাই জানে।
জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। আমি আপনাকে বিশ্বাস করছি।
ভজনা দেবী যে একটু হাসলেন তা বোঝা গেল ঘোমটার অন্ধকারেও তার ঝকঝকে দাত ঝিকিয়ে ওঠায়। বললেন, বিশ্বাস করো?
বিশ্বরূপ এ প্রশ্নটার জবাব দিল না।
ভজনা দেবী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, পুলিশরা সহজে কাউকে বিশ্বাস করে না। একজন পুলিশ অফিসারের তো এমনও সন্দেহ হয়েছিল যে, আমিই নাকি ভাড়াটে খুনি পাঠিয়ে মিশ্রজিকে খুন করিয়েছি। তার কারণ মিজির দ্বিতীয় বিয়ে।
কথাটা বলে ভজনা দেবী একটু আনমনা হয়ে বসে থেকে একটু ধরা গলায় বললেন, না হয় তাই হল, কিন্তু আমি কি পারি লালুয়া আর মহেন্দ্রকে খুন করতে? লালুয়াকে যে এইটুকু বেলা থেকে মানুষ করেছি। আমাকে গাল ভরে মা ডাকত।
আমি মিজির দ্বিতীয় বিয়েটা সম্পর্কে জানতে চাই। উনি বিয়েটা করলেন কেন? হয়তো ওটাও জীবন নিয়ে ওর রিসার্চ। তোমরা পুরুষমানুষেরা বাবা, এমনিতেই একটু নির্লজ্জ। বুড়ো বয়সেও কামকামনা সব দগদগ করে। আর তার জন্য না করতে পারো এমন কাজ নেই।
কিছু যদি মনে করেন, মিশ্রজি কি ওইরকমই ছিলেন?
ভজনা দেবী আবার একটু চুপ করে থাকেন। তারপর ধীর গলায় বলেন, সেটা বললে মিথ্যে কথা বলা হবে বাবা। মিশ্রজি গাঁধীবাবার শিষ্য। মেয়েছেলে নিয়ে ওঁর কোনও দুর্নাম কখনও ছিল না। কিন্তু এই বিয়েটা করেছিলেন আমার ওপর প্রতিশোধ নিতেই।
আপনি জেলাসি ফিল কেন করতেন না?
আমার বয়স কত জানো? আর ন’মাস পর পাক্কা ষাট হবে। এ বয়সে আর জেলাসির কী থাকে বাবা?
জেলাসির কি বয়স আছে?
তুমি অনেক মানুষ ঘেঁটেছ, তোমাকে আর কী বোঝাব বলো! এই বয়সের যে জেলাসি তার রকম আলাদা।
শুনেছি, আপনি মিশ্রজিকে ডিভোর্স দেননি!
ঠিকই শুনেছ। যদিও আমাদের সম্পর্ক আলগা হয়ে গিয়েছিল, তবু বিয়েটা আমি মানতুম। এখনও মানি। যদি কুসংস্কার বলতে চাও তো বোলো। আমাদের পরিবারের শিক্ষা অন্যরকম। আমরা দেওঘরের ঠাকুরজির শিষ্য। ঠাকুরজি ডিভোর্স পছন্দ করতেন না। মিশ্রজি সেটা ভালই জানতেন। ঠাকুরজি যতদিন দেহে ছিলেন, মিশ্রজি তার কাছে যেতেন। উনি দীক্ষা নেননি, কিন্তু শ্রদ্ধা ছিল। মিশ্রজি জানতেন, আমি ডিভোর্সের মামলা মরে গেলেও করব না। কিন্তু উনি করলেন।
আপনি মামলা লড়েননি?
লড়ে কী হবে? যেখানে আমিই ওঁর দু’ চোখের বিষ সেখানে আইনের লড়াই তো পণ্ডশ্রম। লোকে খোরপোশের কথা বলে। লোকেরা আহাম্মক। খোরপোশ নিতে যাব কেন বলো তো। আমি কি ভিখিরি? মিশ্ৰজি অবশ্য দিতে চেয়েছিলেন, আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছি, নেব না। তাতে ওঁর পৌঁরুষে লেগেছিল। উনি হয়তো ভেবেছিলেন, ভজনার আমার খোরপোশ বেঁচে থাকা মানেই ডিভোর্সের পরও একরকম বশ্যতা স্বীকার করা।