তিনখানা পরোটা খেয়ে তৃপ্ত শ্যামল উঠল এবং খবরের কাগজ নিয়ে আর-একবার বসল গিয়ে প্রিয় সোফায়। খবরের কাগজ কী বলছে? খবরের কাগজ বলছে, পৃথিবীর অবস্থা মোটেই সুবিধের নয়। দিনকে দিন আরও খারাপ হবে। এবং আরও। শ্যামল সেটা জানে। কথা হল, ততটা খারাপই হবে যার ঢেউ এসে লাগবে তার চারতলার নিরিবিলি প্রিয় এই ফ্ল্যাটে? ভাবী পৃথিবী গোল্লায় যাক, কিন্তু টুকুসটার কোনও বিপদ হবে না তো! একটু আগে বস্তির বাচ্চাগুলোকে দেখে এসেছে সে, ওরকম কিছু অপেক্ষা করছে না তো তার ডলপুতুলের মতো মেয়েটার জন্য?
তোমার মুখটা আজ এত গোমড়া কেন বলো তো! বাথরুমের দরজায় মুখোমুখি দেখা হল দু’জনের। বকুল বেরোচ্ছে, শ্যামল ঢুকতে যাচ্ছে। কথাটা বলল বকুল।
শ্যামল তার গালে একবার হাত বুলিয়ে নিয়ে বলে, বোধহয় দাড়ি কামাইনি বলে।
দাড়ি কামালেই বুঝি তোমাকে হাসিখুশি লাগে?
মেলাঙ্কলিক ফেস-এরও তো একটা অ্যাট্রাকশন আছে।
সে তোমার মুখ নয়। বিষণ্ণ মুখ আর গোমড়া মুখ কি এক হল?
তফাতটা কী?
সবার মুখে বিষাদ থাকে না, মানায়ও না।
তা হলে কাকে মানায়! হু ইজ দ্যাট রোমিও?
বাঃ রে, কাকে মানায় তা কে খুঁজতে গেছে! তোমাকে মানায় না এটা বলতে পারি।
আমাকে কিছুই মানায় না, আমি জানি।
আহা, আবার ছেলেমানুষের মতো রেগে যাচ্ছে দেখো! তোমাকে অপমান করার জন্য মোটেই কথাটা বলিনি। শুধু সিম্পল একটা প্রশ্ন করেছি, মুখ গোমড়া কেন? তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হল?
হল। আমি মোটেই গোমড়া মুখ করে নেই। আমি একটু চিন্তিত। সেটাকে গোমড়া মুখ বললে অপব্যাখ্যা হয়।
আচ্ছা বাবা, ঘাট মানছি।— চুলে জড়ানো গামছাটা খুলতে খুলতে শ্যামলের দারুণ সুন্দরী স্ত্রী স্নানের পর আরও সুন্দরী দেখাচ্ছে— বলল, জিজ্ঞেস করতে পারি কি যে তুমি চিন্তিতই বা কেন? সকাল থেকে কী এমন ঘটল চিন্তার মতো?
শ্যামল তিলেক বিলম্ব না করে ঝটিতি একটা গল্প বানিয়ে নিয়ে বলল, সুরিন্দর ইজ হিয়ার অ্যান্ড বিশ্বরূপ ইজ হিয়ার। একটা ফ্যাটাল এনকাউন্টার অবশ্যম্ভাবী। উই মে লুজ এ গুড ফ্রেন্ড।
অবাক বকুল বলে, কিছুই তো বুঝলাম না, কী যা-তা বলছ?
শ্যামল একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, বিশ্বরূপ এখানে কেন এসেছে জানো? সুরিন্দরকে ধরতে।
সুরিন্দরটা কে?
ওঃ, ইগনোরেন্স দাই নেম ইজ উয়োম্যান। সুরিন্দর হল সেই সাংঘাতিক আতঙ্কবাদী যার ভয়ে সরকার থরহরি। মাত্র কয়েকদিন আগে দেওঘরে একজন প্রাক্তন এম পি-কে সপরিবারে খুন করেছে। টোটাল ম্যাসাকার। সে এখন কলকাতায়। বিশ্বরূপের আসার কারণ হল সুরিন্দর।
এক ঢিলে দুই পাখি মারতে পারল কি শ্যামল? বউয়ের দ্বিচারিণী মুখখানা সে জহুরির মতো লক্ষ করছিল। সামান্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল কি মুখটা?
তোমাকে কে বলল?
নির্বিকারচিত্তে মিথ্যে কথা বলে গেল শ্যামল।— কে আবার বলবে! বিশ্বরূপ নিজেই। করিডোরে সিগারেট খেতে খেতে। ওর মুখে যে মেলাঙ্কলিক ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছ। সেটা আসলে ভয়।
সুরিন্দর কি টেররিস্ট?
টেররিজমের গডফাদার বলতে পারো। সুরিন্দর ইজ দা রুট অব টেররিজম। আজকের কাগজেই খবরটা আছে। দেখবে?
কেন যে মেয়েরা সাজে, সেটা এক বিরাট কুইজ শ্যামলের কাছে। বকুল স্নান করেছে। সব রূপটান ধুয়ে মুছে গেছে মুখ থেকে। এখন তার কাটা কাটা মুখচোখে স্বাভাবিক সৌন্দর্যের যে অসহনীয় প্রকাশ ঘটেছে তা কি বোঝে তার বোকা বউ?
বকুল শ্লথ অন্যমনস্ক হাতে মাথা থেকে গামছাটা সরিয়ে আনমনা পায়ে শোয়ার ঘরে চলে গেল।
বাথরুমে আজ গান গেয়ে হুল্লোড় করে স্নান করল শ্যামল। গল্পটা দারুণ বানিয়েছে সে। এ কথা খুবই সত্য যে, দুনিয়াতে কোথাও কিছুরই পুরো দখল পাওয়া যায় না। এই যে স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি, কন্যা-পুত্র-কলত্রাদি কোনও কিছুরই ওপরেই মানুষের পুরো প্রভুত্ব নেই। লিজ, লং লিজ বা শর্ট টার্ম পজেশন মাত্র। বউও তাই। বকুলের সম্পূর্ণ হৃদয় জয় করে। নেওয়ার যথেষ্ট যোগ্যতা তার নেই। সম্ভবও নয়। তা হলে একই সঙ্গে তাকে রাজীব গাঁধী, অমিতাভ বচ্চন, ফাইটার পাইলট, ব্রিগেডিয়ার, হেমন্ত মুখার্জি, মাইক টাইসন, মারাদোনা এবং বোরিস বেকার হতে হয়। সুতরাং আংশিক দখল নিয়ে সে মোটামুটি খুশি। মাঝে মাঝে এক-আধজন আগন্তুক যদি সেই দখলে নাক গলায় তা হলেও তেমন কিছু নয়। সেটা স্পোর্টিংলি নিতে পারে শ্যামল। তবে তখন নিজের দখলটা একটু জাহির করেও নেওয়া উচিত। বিষণ্ণবদন ওই পুলিশ অফিসারটি যে খানিকটা মাথা খেয়েছে বকুলের এবং বকুল ওই বিষবেদন অফিসারের, তাতে সন্দেহ নেই। নইলে কেউ গভীর রাতে কষ্ট করে বাড়ি পৌঁছে দেয়! গাড়ির পরিচয় যত প্রগাঢ়ই হোক তা গাড়িতেই শেষ হওয়া উচিত। তাকে আবার বাড়িতে লাঞ্চে বা ডিনারের নেমন্তন্ন করা কেন বাপু?
যখন স্নান করে বেরোল শ্যামল তখন বাইরের ঘরে খবরের কাগজের ওপর আলুথালু হয়ে ঝুঁকে আছে বকুল। আলুথালু বলেই মনে হল শ্যামলের। শোয়ার ঘরে এসে আলমারির পূর্ণাঙ্গ আয়নায় এক কাপুরুষের মুখোমুখি হল শ্যামল।
০৬. গাঁধীবাদ দিয়ে শুরু
॥ ছয় ॥
গাঁধীবাদ দিয়ে শুরু করে সন্ত্রাসবাদ দিয়ে যে শেষ করতে চায়, তাকে কী বলা যায় বলো তো! পাগল? আমি কিন্তু মিশ্রজিকে পাগল বলি না। আমি বলি ও ছিল চঞ্চলমতি, সবসময়ে জীবন নিয়ে নানা পরীক্ষা করত। কী বলল তাকে তোমরা? গবেষণা? তাই হবে। উনি বোধহয় জীবন নিয়ে সবসময়ে রিসার্চ করতেন।