কই মাছ!–বলে আর্তনাদ করে উঠল বকুল। আর্তনাদ না হর্ষধ্বনি তা ঠিক বুঝতে পারল না শ্যামল। সে তো হর্ষধ্বনিই আশা করছিল। সিজনের প্রথম কই!
একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আত্মবিশ্বাসহীন গলায় সে প্রতিধ্বনি করে, কই মাছ! হ্যাঁ, কই। মাছই তো!
কঠিন-সুন্দর, হাস্যবিহীন মুখখানা তার দিকে ফিরিয়ে পলকহীন চোখে তিন সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বকুল বলে, কে কাটবে এখন কই মাছ! সরলা আজ আসেনি। ওই কাঁটাওলা মাছ এখন কে সামলাবে! কাল রাতেই না তোমাকে বলে রেখেছিলুম, শুধু ডিম পেঁয়াজ আর আলু আনলেই হবে!
শ্যামল খুব নিশ্চিন্ত গলায় বলে, নো প্রবলেম। ডিম সামনের মুদির দোকানেই পাওয়া যায়। মাছ বরং ফ্রিজে রেখে দাও।
ফ্রিজে! জ্যান্ত মাছ কখনও ফ্রিজে রাখে কেউ? কী বুদ্ধি!
তা হলে!
জ্যান্ত মাছ জলে রাখতে হয়।
ইয়েস ইয়েস, মাকেও দেখেছি ছেলেবেলায় জিয়োল মাছ জলে ছেড়ে রাখতে। ভুলে। গিয়েছিলাম।
রাখলেই তো হল না। জিইয়ে রাখলে সারাদিন খলবল করবে। সে এক অশান্তি।
কুইজ কনটেস্টের প্রতিযোগীর মতো শক্ত প্রশ্নের পাল্লায় চিন্তিত হয়ে পড়ে শ্যামল। ছোটখাটো কত ব্যাপারই যে কী সাংঘাতিক হয়ে উঠতে পারে!
যাবে? যাও না ওই লাল বাড়িটার পিছনে থাকে। ওর বরের নাম পরিতোষ।
শ্যামল ভারী অবাক হয়ে বলে, কোথায় যেতে বলছ!
সরলাকে ডেকে আনতে। খবর দিলেই চলে আসবে। ভাল ঘুম হয়নি, শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। সরলা এলে সব সামলে নেবে। আজ একটু রেস্ট নেওয়া দরকার।
ঝাড়া দশ মিনিট এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করল শ্যামল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উঠতে হল। লালবাড়ির পেছনে যে একটা বস্তি আছে তাই জানত না সে। বস্তি এমনিতেই নোংরা ও বিপজ্জনক বলে সে শুনেছে। পরিতোষকে সে চেনে না। সরলাকে পাওয়া যাবে কি না কে জানে! বস্তিবাসীরা ফ্ল্যাটবাড়ির লোকদের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন কি? তারা আগন্তুকদের কী নজরে দেখে? অনেক প্রশ্ন মনের মধ্যে। তৎসহ গভীর উদ্বেগ।
অতিশয় উৎকণ্ঠার সঙ্গে সিঁড়ি ভেঙে নামতে লাগল শ্যামল। এ যেন সুরিন্দরের রাইফেলের মুখে এগিয়ে যাওয়া।
লালবাড়ির পিছনে বস্তির চত্বরে ঢুকেই সে দেখতে পেল, রাস্তাময় বাচ্চাকাচ্চা খেলছে। তার মেয়ের চেয়েও ছোট বাচ্চারা বেওয়ারিশের মতো ধুলোবালি নোংরায় পড়ে আছে। সর্পিল একটা রাস্তায় প্রাণ হাতে করে ঢুকল সে এবং একজন মাঝবয়সি মহিলাকে পেয়ে একটু কাঁপা গলায় বলল, পরিতোষের ঘরটা কোথায়?
পরিতোষ! আরও ভিতরবাগে চলে যান। শেষের বাঁ দিকের ঘর।
সরলা কি আছে?
থাকতে পারে। দেখুন গিয়ে।
এগোতেই একটা বাঁধানো চাতাল। সেখানেও বিস্তর বাচ্চা, তবে নোংরা সব কাপড় শুকোচ্ছে, আঁশটে বিচ্ছিরি গন্ধ আসছে পচা মাছ রান্নার।
দাদাবাবু!–বলে আহ্লাদিত সরলা আঁচল সামলে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়াল। সম্ভবত কোলের বাচ্চাটাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিল।
উদ্বেগটা কেটে গেল শ্যামলের। একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলে, তোমার বউদি ডাকছে তোমাকে।
কাল সন্ধেবেলাই তো ফেরার কথা ছিল আপনাদের। আমি গিয়ে সাতটা থেকে সেই রাত ন’টা অবধি বসে ছিলুম।
হ্যাঁ, আমরা মাঝরাতে পৌঁছেছি।
আপনি যান, আমি দশ মিনিটের মধ্যেই যাচ্ছি। খবর পেলে কোন সকালে চলে যেতাম।
বস্তি ছেড়ে ভদ্রলোকদের এলাকায় ঢুকে আরামের শাস ফেলল শ্যামল। চেনা দোকান থেকে এক প্যাকেট দামি ব্র্যান্ডের সিগারেট কিনল। প্রবলেম সলভড়। একটা মস্ত কাজ করার পর বিজয়ীর মতো লাগছে না নিজেকে? কই মাছ রান্না হবে, বকুলের বিশ্রাম হবে, এর চেয়ে সুসংবাদ আর আপাতত কী হতে পারে?
সিগারেট ধরাতে গিয়েই হঠাৎ বিশ্বরূপকে মনে পড়ল। নন-স্মোকার যখন সিগারেট খায় তখন স্মোকাররা স্পষ্টই বুঝতে পারে, লোকটা আনাড়ি। বিশ্বরূপ তাদের পারিবারিক জীবনে খানিকটা ঢুকে পড়ল নাকি? হয়তো আর দেখা হবে না কখনও, শরীরী হয়ে আর আসবে না কাছাকাছি, কিন্তু স্মৃতি হয়ে? চোরাপথে? গোপন হৃদয়ের দরজা খুলে?
বিশ্বরূপ কি একজন হিরো? ডার্ক, টল, হ্যান্ডসাম। জীবন-মৃত্যু নিয়ে নিয়ত ছেলেখেলা করে! যার প্রতিদ্বন্দ্বী সুরিন্দরের মতো ভয়ংকর সব লোক! মেয়েরা কি শুধুই বীরের পূজারি?
এইজন্যই খেলোয়াড়, হিন্দি সিনেমার নায়ক, পাইলট এবং গায়কদের তেমন পছন্দ করে না শ্যামল। এরা হল অনেকটা দীপশিখার মতো, যাতে ঝাপ দিয়ে পুড়ে মরতে চায় নারী পতঙ্গেরা। একটু যাত্রার ডায়ালগের মতো শোনালেও কথাটা তো আর মিথ্যে নয়।
কিন্তু বিশ্বরূপ হিরো কেন? বিশ্বরূপকে কাল অধিক রাত্রি পর্যন্ত পছন্দই তো ছিল শ্যামলের, আজ সকাল থেকে তবে অপছন্দ হচ্ছে কেন? বেলা বাড়ছে, খিদে পেয়েছে। খুব সম্ভবত সরলা গিয়ে জলখাবারের জন্য পরোটা আর আলুচচ্চড়ি বানাচ্ছে। তবু পাড়ার মস্ত সুন্দর পার্কটাতে কিছুক্ষণ বসে গভীরভাবে চিন্তা করল শ্যামল। দুটো সিগারেট উড়ে গেল। কোথাও পৌঁছানো গেল না। চিরকাল তার চিন্তার ধারা একটা চৌমাথায় এসে হারিয়ে যায়। পথ পায় না। ওইখানে একজন ট্র্যাফিক পুলিশ থাকলে তার সুবিধে হত, চিন্তার গতিটাকে ঘুরিয়ে দিতে পারত সঠিক রাস্তায়।
পরোটাই। এবং আলুচচ্চড়িও। সরলাকে পাওয়া না গেলে এই প্রিয় জলখাবারটি আজ কিছুতেই জুটত না শ্যামলের কপালে। বড়জোর পাউরুটি এবং সম্ভবত একটি ডিমসেদ্ধ।