ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে কিছু নেই ঠিকই, যেমন ভগবান নেই, হিপনোটিজম নেই, ভূত নেই, পরি নেই, পক্ষীরাজ ঘোড়া নেই। তবু শ্যামলের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে অনেকক্ষণ ধরে। শ্যামল সেটা বুঝতে পারছিল না এতক্ষণ। হঠাৎ দেয়ালের ইলেকট্রনিক ঘড়িটার দিকে চেয়ে সে ঝড়াক করে উঠে দাঁড়াল। বাজার! আজ সকালে বাজার না হলে রান্না হবে না। বাজার এনে ফেলতে হবে পৌঁনে আটটার মধ্যেই, কারণ প্রতি সকালে সে সাতটা পঞ্চাশ মিনিটের টিভি-র ইংরিজি খবরটা ভক্তিভরে দেখে এবং শোনে। সকালের খবরটায় কিছু বিদেশি সংবাদ থাকে।
ঘরে এসে পাতলুন চড়াতে চড়াতে সে তার বউ আর মেয়েকে লক্ষ করে। তার গোটা দুনিয়া কনসেনট্রেট করে আছে এইখানে, ওই বিছানায়। সে যা-কিছু করে তার যাবতীয় শ্রম ও চিন্তা, উদ্বেগ ও প্ল্যানিং সব কিছু মাত্র এই দু’জনকে কেন্দ্র করে। অথচ পৃথিবীটা কত বড় এবং তাতে জীবাণুর মতো কোটি কোটি মানুষ। রোগ-ভোগ, এইডস, ক্যানসার, ভূমিকম্প, বন্যা, আগুন, সুরিন্দর সবাই মিলে এত মেরে মেরেও নিকেশ করতে পারছে না। রক্তবীজের ঝাড় জনসংখ্যা ক্রমে সংখ্যা ছাড়িয়ে চলেছে অসীমের দিকে। এই এত মানুষের জন্য তার কোনও চিন্তা নেই, দায় নেই, দায়িত্ব নেই। তার জন্য মাত্র দুটো মানুষ! ওনলি টু! এবং দুটোই লেডিজ!
বকুলের মুখে কোনও আঁচিল ছিল কি? সর্বনাশ! মনে তো পড়ছে না! কিন্তু ঘুমন্ত বকুলের মুখে বাঁ চোখের নীচে মস্ত আঁচিলটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে! তাহলে কি ছিল, সে লক্ষ করেনি এতদিন! এবং আঁচিলটার ফলে বকুলকে যে আরও সুন্দর দেখাচ্ছে, এটাও সে লক্ষ করেনি নাকি এতদিন! সর্বনাশ! এতকালের— না হোক পাঁচ বছরের তো বটেই বিয়ে করা বউয়ের আইডেন্টিফিকেশন মার্কগুলো তার জানা নেই, এটা কেমন কথা? সত্য বটে মেয়েদের চেনে এমন বাপের ব্যাটা আজও জন্মায়নি, তা বলে আঁচিলটা এতকাল তার চোখকে ফাঁকি দিয়ে রয়ে গেল কী করে?
একটু ঝুঁকে সে দেখতে পেল, না আঁচিল নয়, একটা মাছি। আগন্তুকের সাড়া পেয়েই উড়ে গেল। বাঁচা গেল বাপ! শ্যামল তো ঘামতে শুরু করেছিল, মাঝরাতের ট্রেন থেকে কোনও পরমহিলাকে ঘুমচোখে নামিয়ে নিয়ে এল নাকি।
জামা পরতে পরতে হঠাৎ আবার শ্যামল একটু ঝুঁকে বকুলের মুখখানা দেখল। হতেও পারে, এ এক পরমহিলাই। মুখে একটু মৃদু সুন্দর সুখের হাসি, একটা স্বপ্নময়তার চোরা ঢেউ যেন উথলে আনছে মুখের লাবণ্যকে। বকুল সুন্দর বটে, কিন্তু এ যে সামথিং এল। পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে শ্যামল। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এখন এই মুহূর্তে বকুল তার বউ নয়। বকুল এখন অন্য কাউকে দেখছে স্বপ্নে। অন্য এক পুরুষ কি? যার মধ্যে শ্যামলের ড্র-ব্যাকগুলো নেই?
কে লোকটা? কাল গাড়ির সেই পুলিশ অফিসারটি কি? সেই বিষণ্ণ রুস্তম!হ্যাঁ, হ্যান্ডসাম, মেলাঙ্কলিক, লোনলি সব ঠিক আছে। পুরুষালিও। তাই বলে… ঠিক আছে ভাই, চালিয়ে যাও। চালিয়ে যাও। লাইফ তো দু’দিনের বই নয়। যা পাও, কুড়িয়ে কাচিয়ে লুটেপুটে তুলে নাও জীবন থেকে। শ্যামল আদ্যন্ত স্পোর্টসম্যান। কিছু মাইন্ড করবে না।
ছোকরা ব্রড-মাইন্ডেড বলে ভেবেছিল শ্যামল। এখন মনে হচ্ছে, ডাল মে কুছ কালা ভি হ্যায়। এমন তো হতেই পারে যে, ট্রেনে গতকাল অনেকক্ষণ দু’জনে দু’জনকে একটু একলাএকলি পেয়েছিল। এবং তখন একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়ে যায়! কিছুই অসম্ভব নয়। ট্রেনটা ওইরকম অসম্ভব লেট না করলে হয়তো ঘটতে পারত না ব্যাপারটা।
ট্রেন লেট করা যে খুব খারাপ তা বাজারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হৃদয়ঙ্গম করল সে। ট্রেন লেট হওয়ার বিরুদ্ধে সে কাগজে খুব কড়া করে চিঠি লিখবে।
এমন কি হতে পারে যে, সুরিন্দরকে ধরার জন্যই বিশ্বরূপকে দিল্লি থেকে পাঠানো হয়েছে! হতেই পারে। সে ক্ষেত্রে বিশ্বরূপের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা খুব কম। সুরিন্দরের এ কে ফটি সেভেন আছে। বাক আপ সুরিন্দর, তোলো এ কে ফর্টি সেভেন, চালাও গোলি, খতম কর দো শ্যালেকো…
বাজার করাটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়ে থাকে শ্যামল। তার ভিতরে যে লড়াকু লোকটা আছে সে মালকেঁাচা মারে, আস্তিন গোটায়, পাঁয়তারা ভাঁজে, বাজার মানেই ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতাঃ যুযুৎসবঃ, প্রত্যেকেই দুর্যোধন, দুঃশাসন, জরাসন্ধ। কাম অন দুর্যোধন, কাম অন দুঃশাসন..
স্যার, অনেকদিন দেখিনি আপনাকে! পুজোয় বাইরে গিয়েছিলেন বুঝি! ভাল পিরশে আনলাম একদিন, আপনি তো পারশে খুব ভালবাসেন, খুব মনে হচ্ছিল আপনার কথা।
সাবধান! সাবধান!–বলে ভিতরের লড়াকু লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, দুঃশাসন প্যাঁচ কষছে স্যার ডেকে, নেই আঁকড়ে ভাব করে তোমাকে ভিজিয়ে ফেলছে, বি স্ট্রং অ্যান্ড আনবেন্ডিং …
কিন্তু এখনকার দুঃশাসনদের অস্ত্রশস্ত্র আলাদা। এ এক অন্য ধরনের এ কে ফর্টি সেভেন।
আজ ফার্স্টক্লাস কই আছে স্যার, এ বাজারে এই প্রথম উঠল। দর একটু কম করে দেব’খন।
শ্যামল ভিজল এবং নেতিয়ে পড়ল। দশখানা কই মাছ দাপাতে লাগল তার নাইলনের ছোট ব্যাগে। সম্ভবত তারাও ভৎসনাই করতে চাইছে তাকে। সে যে কলকাতায় ছিল না, অনেকদিন সে যে বাজারে আসেনি এটা লক্ষ করেছে আলুওয়ালাও। লক্ষ করেছে সবজিওয়ালাও। লক্ষ করেছে ডিমউলিও। খুবই বিস্ময়কর ব্যাপার। তার বিরহে এরা খানিকটা কাতরও ছিল! দীর্ঘ বিরহের পর নিজের প্রিয়জনকে দেখে মানুষ যেমন খুশি হয় তেমনই খুশির ভাব এদের মুখেচোখে! পকেটে রুমাল থাকলে চোখের আনন্দাশ্রু মুছে ফেলত শ্যামল। তাড়াহুড়োয় রুমাল আনতে ভুলে গেছে। তবু সজল চোখে চারদিকে চেয়ে দেখল শ্যামল, ওহে কৃষ্ণ, উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন করো, আমাকে দেখতে দাও কে আমার শত্ৰু, কে আমার মিত্র। আজ শ্যামল শত্রুপক্ষ খুঁজেই পেল না। সকলকেই তার বন্ধু বলে মনে হতে লাগল।