কিন্তু বকুল জাগা মানেই বিবেক জাগল। বিবেক জেগে উঠেই তাকে নিয়ে পড়ল। সে যে কত অপদার্থ, কত অযোগ্য, কত ভিতু, কত অসফল সেই সব কথাই তার বিবেকের হয়ে প্রম্পট করে বকুল। সেই বকুল যাকে ছাড়া বাঁচবে না, নির্ঘাত মরে যাবে বলে মনে হয়েছিল তার, একদা। ওই একদা কথাটাই তাকে পেড়ে ফেলে। কেন সে একদা যে অত বোকা ছিল, প্রেমিক ও রোমান্টিক। শেকসপিয়র সাহেবও কি বোকা ছিলেন না? রোমিও জুলিয়েটের ট্র্যাজিক প্রেমের গল্প আজও দুনিয়াসুদ্ধ লোককে কাঁদায়। দুনিয়াসুদ্ধ লোক যদি তারই মতো বুরবক হয় তা হলে কী করতে পারে শ্যামল? শেকসপিয়র সাহেব, যদি রোমিও আর জুলিয়েটকে মিলিয়ে দিতেন তা হলে কী হত স্যার, একবার ভেবে দেখেছেন। প্রেমের কথাটুকুই লিখেই কলম পুঁছে ফেললেন, কিন্তু গল্পের পরও তো গল্প আছে। ধরুন স্যার, রোমিও আর জুলিয়েট বিয়েতে বসল, তিন মাস পর থেকে শুরু হল খটাখটি, তারপর চেঁচামেচি এবং চঁা ভা, আর তারপর সাহেবদের দেশ বলে কথা, রোমিওর হয়তো জুটল আরও জুলিয়েট, জুলিয়েটের জুটল আরও রোমিও, কেঁচে গেল বিয়ে কেঁচে গেল প্রেম, খাট্টা হয়ে গেল সম্পর্ক। এইসব প্রেমের কী দাম আছে মশাই? তবু যে প্রেমটা কেন বর্তে আছে দুনিয়ায় সেটাই হল প্রশ্ন।
আজকাল তার মাঝে মাঝেই মনে হয়, খুব মনে হয়, মানুষের এইসব ভ্যাবলাকান্ত আচরণের পিছনে কারও একটা অদৃশ্য হাত আছে। অতি পাজি ও ধূর্ত একটা হাত। তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নেওয়া যায় যে হাতটা ওই বিতর্কিত পার্সোনালিটি ভগবানের তা হলে স্বীকার করতেই হয় ওরকম লোকের জন্য গির্জা-মন্দির-মসজিদ বানানো নিতান্তই গাঁটগচ্চা দেওয়া। রামমন্দির বাবরি মসজিদের কাজিয়ার পিছনে কি ওই কালো হাতটাই নেই? একটা অ্যান্টি-গড মিছিল বের করলে কেমন হয়? তাতে স্লোগান থাকবে, ভগবানের কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।
রোদটা চোরের মতো ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে ঘাড়ের কাছে। উত্তরমুখো ফ্ল্যাট বলে শীতে রোদ আসে না। এই ভৌগোলিক গণ্ডগোলের জন্য সে ছাড়া আর কোন অদূরদর্শী আহাম্মক দায়ী। সকালের এই এক চিলতে রোদ দাঁত কেলিয়ে তার সঙ্গে একটু হেঁ হেঁ ভদ্রতা করতে আসে। মাঝে মাঝে তার চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, গেট আউট! নিকালো হিয়াসে! ছ্যাচড়া কোথাকার, যারা কপাল করে এসেছে তাদের বাড়ি গিয়ে চাকরের মতো শীতের রোদ ঢেলে দিয়ে এসো গিয়ে। তোমাদের সবাইকে হাড়ে হাড়ে জানি।
সকালের সুখ-সুখ ভাবটা মানসিক উত্তেজনায় চলে যেতে চাইছে। শ্যামল নিজেকে শাসন ও সংযত করল। রোদের দিকে চেয়ে বলল, অলরাইট ম্যান, তোমার ওপর আমার রাগ নেই। এসেছ যখন, ওয়েলকাম। কিন্তু আমার দুঃখের কপালটার কথাও একটু ভেবো হে। দুনিয়ায় আমার যত চেনা-জানা সবাই কেমন সাউথ-ফেসিং ফ্ল্যাট পায়? কার কালো হাত অলক্ষ্যে কাজ করে বলল তো! গ্রেটা গার্বো নয়, সায়রা বানু নয়, শ্রীদেবী নয়, মোস্ট অর্ডিনারি একটা বাঙালি মেয়ের কাছে এই নর্থ-ফেসিং ফ্ল্যাটের জন্য আমাকে কীরকম নাকাল হতে হয়, জানো? আর বদমাশ প্রোমোটার ব্যাটা আমাকে বুঝিয়েছিল, বেশ মোলায়েম আন্তরিক গদগদ গলায় সেই পাক্কা হেড টু ফুট চারশো বিশ আমাকে বুঝিয়েছিল, দুটো → একটু বিস্ময়ে উপরে তুলে বুঝিয়েছিল, সে কী দাশগুপ্ত সাহেব, আপনিও এই দক্ষিণের দলে? আপনি তো কালচার্ড মানুষ, নিশ্চয়ই জানেন, আর্টিস্টদের পছন্দ উত্তরের ফ্ল্যাট, উত্তরের আলো হচ্ছে ছবি আঁকার পক্ষে সবচেয়ে ভাল। যার চোখ আছে, পছন্দ আছে, রুচি আছে সে যে কেন দক্ষিণের ফ্ল্যাট নেয়! আমার হয়ে গেল ওই শুনে। তেলে ভগবান মজে, আমি তো ছার। ভেবে বোসো না যে আমি ভগবানে বিশ্বাস করি। তবে আমি যে এক সময়ে একটু আধটু ছবিও আঁকতুম, সেই ধূসর স্মৃতি এমন ঠেলে উঠল যে, অন দি স্পট ডিসিশন নিয়ে ফেললুম, নাঃ, উত্তরের ফ্ল্যাটই নেব। এখনও সেই আহাম্মকির হ্যাপা সামলাতে হচ্ছে।
কাগজে মন বসাতে পারছিল না শ্যামল। কত অ্যাং ব্যাং খবরে বোঝাই, মিথ্যের ঝুড়ি, পলিটিকসের কূটকচালিতে আঁস্তাকুড় খবরের কাগজ জিনিসটা না হলে কেন যে তবু সকালে মানুষের কোষ্ঠ পরিষ্কার হতে চায় না তা বোঝে না শ্যামল। চা খেতে খেতে অন্তত পঁচিশ দিন বাদে কলকাতার খবরের কাগজ পড়ছে সে।
পাতা উলটে একটা খবরে চোখ আটকাল তার। দেওঘরে একজন এম পি তার নিজের বাড়িতে খুন হয়েছেন। হত্যাকারীরা উগ্রবাদী এবং বহিরাগত। হত্যার আগে কয়েকদিন তারা নিহতের পুরো পরিবারকে একরকম বন্দি করে রাখে এবং প্রচুর টাকা আদায় করে নেয়। সন্দেহ করা হচ্ছে উগ্রবাদীদের নেতা কুখ্যাত সুরিন্দর। পীতাম্বর মিশ্রকে সপরিবারে খুন করার পর তারা গভীর রাতের ডাউন দানাপুর এক্সপ্রেসে কলকাতা পালিয়ে গেছে।
সন্ত্রাস আর সন্ত্রাস। অন্তত পশ্চিমবঙ্গটা এদের আওতায় ছিল না এতদিন। এখন যদি একে একে দুইয়ে দুইয়ে এখানেও ঢুকতে থাকে তা হলে আর ভরসাটা কীসের? ওরা বাজারে হাটে যেখানে সেখানে ট্যারা-রা-রা ট্যাট… ট্যাট করে ছেড়ে দিচ্ছে ঝাকে ঝাকে গুলি, টু হুম ইট মে কনসার্ন। রাম গেল না রহিম গেল তাতে কিছু যায় আসে না। মাত্র দুটো এ কে ফর্টি সেভেন নিয়ে দুটো শিখ উগ্রবাদী গোটা পুরুলিয়াকে প্রায় দখল করে নিয়েছিল, ভোলেনি শ্যামল। মাত্র সপ্তদশ অশ্বারোহী একদিন বুড়ো রাজা লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য বাংলাকে জয় করে নিয়েছিল, তার চেয়েও এটা আরও খারাপ ঘটনা। আবার তার চেয়েও খারাপ এই সুরিন্দরের এদিকপানে আসা।