অপারেশন সুরিন্দর। কলকাতার পুলিশ সন্দেহজনক দু’জনকে গ্রেফতার করে রেখেছে। দলে আরও একজন ছিল, সে পালিয়ে গেছে। বিশ্বরূপ জানে, ধৃত দুজনের কেউ বা পলাতক লোকটি সুরিন্দর নয়। সুরিন্দরকে গ্রেফতার করতে হলে পুরোদস্তুর যুদ্ধ হবে। কিছু লোকের মৃত্যু অবধারিত। সুরিন্দর মিলিটারি প্রশিক্ষণ পাওয়া লোক, পুরোদস্তুর কম্যান্ডো। নিজেকে সবসময়ে কন্ডিশনিং-এ রাখে। সারা ভারতবর্ষে তার সমব্যথী ও বন্ধু ছড়ানো। পীতাম্বর মিশ্রকে সপরিবারে খুন করে সে সোজা কলকাতায় চলে আসবে এটা নাও হতে পারে।
সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা প্রয়োজন ঠিকই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন গ্রেফতার না করে অনুসরণ করা ও গতিবিধির ওপর লক্ষ রাখা। তাতে গোটা দলের হদিশ পাওয়ার আশা থাকে। কিন্তু এই সূক্ষ্ম বুদ্ধিমত্তার কাজে পুলিশ কিছুটা ঢিলা।
স্যার, হোটেলে যাবেন?
লোকদুটোকে কোথায় রাখা হয়েছে?
হেয়ার স্ট্রিট লক-আপে।
সেখানেই চলুন।
জিপ তাকে হেয়ার স্ট্রিটে নিয়ে এল। কয়েকজন ক্লান্ত কনস্টেবল ছাড়া বিশেষ কেউ নেই। তারাই খাতির করে লকআপে নিয়ে গেল তাকে। কম্বলের বিছানায় দু’জন চিতপাত হয়ে ঘুমোচ্ছ।
এরাই কি স্যার?
না। বড়বাবুকে বলবেন, অন্য কোনও অভিযোগ না থাকলে এদের কাল সকালে রিলিজ করে দিতে।
সুরিন্দরের ফোটোর সঙ্গে ডানদিকের লোকটার কিছু মিল আছে স্যার।
সুরিন্দর আর আমি দিল্লির একই ক্লাবে একসঙ্গে হকি খেলতাম। তাকে আধ মাইল দূর থেকেও চিনতে পারব।
তা হলে ঠিক আছে স্যার। বড়বাবুকে বলব।
ক্লান্ত বিশ্বরূপ এসপ্ল্যানেডের কাছে একটা হোটেলের বুক করা ঘরে ফিরল রাত আড়াইটেয়। ধৃত দু’জনকেই চেনে বিশ্বরূপ। পুরনো দিল্লির স্মাগলার। বাংলাদেশ, নেপাল, চিন সীমান্ত দিয়ে এদের কাজ-কারবার। সোনা, ইলেকট্রনিক জিনিস আর কসমেটিকস এর কারবার, দু’জনেই পুলিশের টাউট, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে পুলিশের ভাইট্যাল লিঙ্ক। অপরাধী বটে, কিন্তু উপকারী বন্ধুও।
বিশ্বরূপ বিছানায় শুয়েই ঘুমোল। কলকাতায় তার কোনও কাজ নেই। সকালে ট্রেন ধরতে হবে। গন্তব্য যশিডি, পাটনা। সামনে ঘুমহীন অনেক রাত অপেক্ষা করছে তার জন্য। অপেক্ষা করছে গুপ্তঘাতক ও আততায়ী। অপেক্ষা করছে পরাজয়, গ্লানি, রক্তপাত বা গৌরবহীন জয়। তার চেয়ে বেশি ক্লান্তি, বিষাদ, শূন্যতা।
লম্বা ঘাসের উঁটি বেয়ে একটা পিঁপড়ে খামোখাই ওপরে ওঠে। দোল খায়। তারপর ফের নামে। ঘাসের গভীর অরণ্যে কোথা থেকে কোথায় চলে যায়। পিঁপড়েরা কি পথ চিনে চিনে ঘরে ফিরে আসতে পারে? বটপাতায় একটা পিঁপড়েকে তুলে নিয়ে অনেক দূরে গিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল বিশ্বরূপ। কোনও চঞ্চলতা প্রকাশ করেনি পিঁপড়েটা। নিশ্চিন্তে বটপাতা থেকে নেমে অচেনা মুলুকে গটগট করে হেঁটে চলে গেল কোথায় যেন! পিঁপড়ের দেশ নেই। মানুষের আছে! দাদু তাকে নিয়ে মাঝে মাঝে বনগাঁ সীমান্তে যেত। চেকপোস্টের এপাশে দাঁড়িয়ে ওই পাশের দিকে মায়াভরা চোখে চেয়ে থাকত। ওই দিকে কোথাও তার দেশ। বিশ্বরূপ তার গভীর ঘুমের মধ্যেই পাশ ফেরে। হলধর ভূত আর জলধর ভূতের লড়াইতে কেউ হারে না, কেউ জেতে না। কিন্তু রোজ তারা লড়াই করে। শেষহীন লড়াই। অন্তহীন, জয়-পরাজয়হীন এই লড়াই আজও হয় ওইখানে, ওই মাঠের মধ্যে, যেখানে জ্যোৎস্নারাতে পরিরা নামে, যেখানে মাঝে মাঝে কাদুয়া চোরকে গোলপোস্টে বেঁধে পেটানো হয়, আর ঘাসের মধ্যে নির্বিকার ঘুরে বেড়ায় পিঁপড়ে। প্রতিদিন ওই মাঠ ক্লান্ত পায়ে পেরোয় দুঃখী দেবীলাল।
০৫. কলকাতার খবরের কাগজ
॥ পাঁচ ৷৷
আঃ! আবার কতদিন পর কলকাতার খবরের কাগজ! কলকাতার ভোর। কলকাতার সোঁদা স্যাঁতা গন্ধ! গত রাত্রি যেন দুঃস্বপ্নের মতো প্যাভেলিয়নে ফিরে গেছে।
মাঝরাত্তিরে শুয়েও ভোরবেলা উঠেছে শ্যামল। পৌঁনে ছ’টায়। উঠেই কেমন ফ্রেশ লাগছে। ক্লান্তি নেই, গ্লানি নেই। মনটা ফুরফুর করছে। আজ অবধি তার ছুটি। কাল জয়েন করবে অফিসে। একটি আলস্যে ভরা শ্লথ দিন সামনে পড়ে আছে ভাবলেই মনটা খুশিয়াল হয়ে ওঠে।
তার ফ্ল্যাটটা মাঝারি মাপের। তিনটে শোওয়ার ঘর, একটা লম্বা ডাইনিং কাম লিভিং, ছোট ব্যালকনি। চারতলার মনোরম আবাস, তার রঙিন টিভি আছে, দেয়ালে প্লাস্টিক পেইন্ট, দু-চারটে বেশ দামি আসবাব, ওয়াল ক্যাবিনেট, প্রাণপণে খরচ করে সাজিয়েছে তারা। যদি তাতে সুখী হওয়া যায়। মুশকিল হল সুখ একবগ্না জিনিস নয়। এই যে সকালবেলাটা তার এত ভাল লাগছে— এ সুখ হয়তো বেলা দশটায় আউট হয়ে প্যাভেলিয়নে ফিরে যাবে, ব্যাট করতে নামবে তিক্ততা এবং রাগের একটি জুটি। তারা হয়তো অনেকক্ষণ টিকে থাকবে উইকেটে। যতক্ষণ বকুল ঘুম থেকে উঠছে না ততক্ষণে নিশ্চিন্ত। উঠলেই কিন্তু অনিশ্চয়তা দেখা দেবে।
বকুল এখন গভীর ঘুমে। পাশে টুকুস, গভীর ঘুমে। চটপট নিজের হাতে চা করে নিল শ্যামল। তারপর চায়ের কাপ আর খবরের কাগজ নিয়ে বসল তার অভ্যস্ত প্রিয় সোফায়, পাশেই জানালা। পুবের রোদ একটু কোনাচে হয়ে এই সময়টায় ঢোকে তার ফ্ল্যাটে। দু’পাশে এবং সামনে উঁচু উঁচু বাড়ি থাকায় এ বাড়িতে ঢুকতে রোদকে রীতিমতো ব্যায়াম করতে হয়। তা হোক তবু তার ফ্ল্যাটে যথেষ্ট আলো হাওয়া আছে। সে সুখী। যতক্ষণ বকুল ঘুমোচ্ছে ততক্ষণ সে সুখী…