বিশ্বরূপ বকুলের দিকে চেয়ে তার ধীর গম্ভীর গলায় বলে, ঠিকই বলেছেন আপনি। আমাদের বউ হতে যদি কেউ রাজিও হয় তবে তার কপালে বিস্তর দুঃখ জমা আছে।
গাড়ি বর্ধমান ছাড়ল। বকুল তার গলার হারখানা ঠোঁটে নিয়ে একটু খেলা করে। মানুষ কখন যে কী করে তার ঠিক নেই। একটু চাপা হাসির ভাব আছে মুখে। বলল, তবু কেউ হয়তো সব জেনেই বিয়ে করতে রাজি হয়ে যাবে। তেমন মেয়েও কি আর নেই? আমার তো খুব ইচ্ছে ছিল একজন জঙ্গি পাইলট বা মিলিটারি অফিসারকে বিয়ে করি।
মানুষের প্রফেশনটা খুব বড় কথা নয়।
তবে কোনটা বড় কথা?মানুষটা? ওসব হল দার্শনিক কথা। আজকাল সবাই প্রফেশনটারই দাম দেয়। তবে আমি কিন্তু কখনও পুলিশ পছন্দ করিনি।
সেটা আগেই বলেছেন।
বকুল হাসছিল, জিরো জিরো সেভেন হলে অবশ্য আলাদা কথা। বা শার্লক হোমস।
ও দুটোই অলীক।
তা জানি মশাই। বাচ্চা ছেলেটাও জানে। ওরকম স্পাইও হয় না, ওরকম গোয়েন্দাও নেই। তবু কী থ্রিলিং ক্যারেকটার বলুন?
হ্যাঁ, সবসময়ে জয়ী, সবসময়েই সফল। ওরকম যদি বাস্তবেও হত।
হয় না, না?
বিশ্বরূপ হাসল, না। মাঝে মাঝে আমরা ভীষণ কাপুরুষের মতো আচরণ করি। পালাই। হারি। সাকসেস স্টোরির চেয়ে আমাদের আনসাকসেস স্টোরি অনেক বেশি লম্বা। তা যদি না হত তা হলে অপরাধীতে দেশটা এত ভরে যেত না।
আপনিও কি লাইসেন্সড টু কিল?
বিশ্বরূপ অসহায়ের মতো মুখ করে বলে, এ দেশে সবাই লাইসেন্সড টু কিল।
বর্ধমান ছেড়ে গাড়ি এখন চমৎকার দৌড়োচ্ছ। ঘুমন্ত মুখটা বাঙ্ক থেকে ঝুলিয়ে শ্যামল জিজ্ঞেস করে, ক’টা বাজে?
বকুল বলে, সাড়ে বারো।
আমরা কোথায়?
এই তো বর্ধমান পেরোলাম।
ওঃ, তা হলে দেরি আছে।
দেরি নেই। নামো৷ জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে হবে।
রাত দেড়টায় সত্যিই কলকাতা পৌঁছে গেল তারা। যাত্রীদের মধ্যে হুড়োহুড়ি ছিল, যদি ভাগ্যক্রমে দু-একটা ট্যাক্সি থাকে সেই আশায়। অব্যবস্থায় ভরা বিশৃঙ্খল উদ্ধৃঙ্খল এই দেশে কাউকে কারও দোষারোপ করার নেই।
উদ্বিগ্ন শ্যামল বলে, আপনার গাড়ি আছে তো বিশ্বরূপ?
বিশ্বরূপ তার জায়গা থেকে নড়েনি। নয় নম্বর প্ল্যাটফর্মে গাড়ি ঢুকেছে। সামনেই কারপার্ক। জানালার সোজাসুজি পুলিশ-জিপটা দেখতে পাচ্ছিল বিশ্বরূপ। ঠিক এ রকম জায়গাতেই থাকার কথা। পুলিশের ইউনিফর্ম পরা একজন সশস্ত্র লোক জিপের পাশে দাঁড়িয়ে। চোখ গাড়ির দিকে।
আছে। চলুন। গাড়িটা কিন্তু জিপ, আপনাদের একটু অসুবিধে হবে।
অসুবিধে! কী যে বলেন! এই মাঝরাতে কলকাতা শহরে জিপই আমাদের রোলসরয়েস।
বউ-বাচ্চা-মাল নিয়ে শ্যামল উঠল জিপের পিছনে। সামনে বিশ্বরূপ, ড্রাইভারের পাশে। বিশ্বরূপের ঘাড়ের কাছে সিটের কানায় একখানা নরম হাত। চুড়ির শব্দ। বকুল ঠিক তার পিছনেই বসেছে। ইচ্ছে করেই কি? জীবন ক্ষণস্থায়ী। সেইজন্যই এর প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। সামান্য প্রাপ্তিকেও ফেলতে নেই। বিশ্বরূপ খুব গভীরভাবে শ্বাস নিল। কলকাতার বাতাস অপরিশুদ্ধ। বায়ুদূষণ সাংঘাতিক। প্রকৃতিহীন এই শহরকে সবাই ভয় পায়। কিন্তু এই গভীর রাতে, জিপটা যখন ভ্যাম্প ঘুরে হাওড়া ব্রিজে উঠে এল তখন গঙ্গার ঠান্ডা জল-ছোঁয়া বাসটি বড় শুদ্ধ বলে মনে হয়।
আপনার শীত করছে না?–মেয়েলি গলা।
বিশ্বরূপ মাথা নাড়ল, না। কলকাতায় শীত কোথায়?
শ্যামল হঠাৎ উদ্বেগের গলায় বলে, এই যাঃ, মাসিমার খবর নেওয়া হল না যে! তাড়াহুড়োয় ভীষণ ভুল হয়ে গেছে।
মাসিমার তো গাড়ি আসবেই। যদু থাকবে। চিন্তা কীসের?
তবু কার্টসি বলে একটা জিনিস আছে তো!
নেই। উনি কার্টসি দেখিয়েছেন আমাদের? কই একবারও তো বলেননি, এত রাতে পৌঁছোবে, ঠিক আছে আমার গাড়ি বরং পৌঁছে দেবে তোমাদের। বলেছেন একবারও?
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বোধহয় একটা মনোমালিন্য পাকিয়ে উঠছে। বাড়িতে গিয়ে হয়তো জনান্তিকে সেটা ফেটে পড়বে। বিশ্বরূপ তার ধীর ভাঙা গলায় বলে, শ্যামলবাবু, রাস্তাটা একটু খেয়াল রাখবেন। কাঁকুড়গাছি আর বেশি দূরে নয়। আমরা মানিকতলা পেরোচ্ছি।
মানিকতলা? এত তাড়াতাড়ি?
এরা বাড়ি ফিরছে। ভ্রমণের আনন্দের পর বাড়ি ফেরার নিশ্চিন্ত। বাড়ি ফিরে সংসারে মজে যাবে। ঝগড়া-বিবাদ-মান-অভিমান খুনসুটি-ভালবাসা সব মিলেমিশে একটা সম্পর্ক শেষ অবধি স্থায়ী হবে। যতদিন মৃত্যু এসে বিচ্ছেদ না ঘটায়। বিশ্বরূপের ঠিক এরকম জীবন বোধহয় হবে না আর কখনও।
খুব নরম করে বকুল বলল, এক কাপ কফি খেয়ে যাবেন কিন্তু! নইলে ছাড়ব না।
বিশ্বরূপ মাথা নেড়ে বলে, না। এত রাতে নয়।
আপনি আমাদের জন্য এত কষ্ট করলেন, আমাদের কিছু করতে দিচ্ছেন না কেন?
শোধবোধ করতে চান? পাওনা রইল।
এবার দিল্লি গেলে ঠিক আপনাকে খুঁজে বের করব। ঠিকানা টুকে রেখেছি।
ওয়েলকাম।
আপনি তো কাল বা পরশু, আপনার সুবিধেমতো আমাদের বাড়িতে লাঞ্চ বা ডিনারে আসতে পারেন?
আমি কলকাতায় থাকব না। কালই হয়তো যশিডির ট্রেন ধরতে হবে।
কী এত কাজ বলুন তো আপনার!
ক্রাইম। ক্রাইম আফটার ক্রাইম।
শ্যামল বলে উঠল, এই যে ডানদিকে।
গাড়ি ডাইনে চওড়া রাস্তায় ঢুকল।
এবার বাঁ দিকে।
কয়েকবার মোড় নিল গাড়ি। তারপর মস্ত একটা অ্যাপার্টমেন্ট হাউসের সামনে এসে দাঁড়াল।
মালপত্র নামল। ওরা নামল। ভদ্রতাসূচক কিছু কথাবার্তা ও আবার দেখা হওয়ার আশ্বাসের পর জিপ ঘুরিয়ে নিল মুখ। তারপর হু হু করে দূরত্ব বাড়িয়ে নিল চোখের পলকে। দূরত্বই ভাল। গার্হস্থ্য থেকে তার দূরে থাকাই উচিত।