ওই চোখদুটো তার পিছু নিয়েছিল সেদিন থেকে। তিনদিন বাদে ফোন এল মেয়েটির, তোমার সঙ্গে দেখা হতে পারে?
তখনই সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল তার। কেননা সে মেয়েটিকে নিজের ফোন নম্বর দেয়নি। হয়তো সন্দেহ হয়েছিল, সেটা দাঁড়ায়নি, আবেগে ভেসে গিয়েছিল। লখিন্দরের লোহার বাসরেও তো ফুটো ছিল!
সরলা কুঁয়ারি নিজের পরিচয় দিয়েছিল দিল্লির মেয়ে বলে। মা বাবা নেই। এক পিসির কাছে মানুষ। পলিটিক্যাল সায়েন্স নিয়ে বি এ পড়ছে দিল্লির কলেজে। দেখা হল প্রগতি ময়দানের এক একজিবিশনে। তারপর দেখা হতে লাগল। সরলা হাসে কম, কথা কম, শুধু গভীরভাবে তাকায়। সেটাই ওর কথা।
এক মাস মাত্র সময় নিল তারা। তারপর বিয়ে করে ফেলল।
বিশ্বরূপের জীবনে এই বিয়ের চেয়ে ভাল ঘটনা আর কিছুই ঘটেনি। সরলা বুদ্ধিমতী, কাজে চটপটে, সেবায় সিদ্ধহস্ত। যত রাতেই ফিরুক বিশ্বরূপ, গরম কফি পেয়েছে সঠিক মাপের চিনি ও দুধসহ। ঝরঝরে ভাত রাঁধতে পারত সরলা, জামা-কাপড় ইস্ত্রি করতে পারত। ঘর সাজাতে ভালবাসত। কখনও ঝগড়া বিবাদ করেনি।
মাত্র তিনমাস সেই অপরিমেয় গার্হস্থ্যের সুখ স্থায়ী ছিল। একদিন অফিসে কাজ করছে, হঠাৎ মালহোত্রা এসে বলল, বিশু, বাড়ি যাও। ব্যাড নিউজ।
বিশ্বরূপ চমকে উঠে বলে, ইজ শি ডেড?
না, তার চেয়ে খারাপ। শি ইজ আন্ডার অ্যারেস্ট।
বিশ্বরূপের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, অ্যারেস্ট! কী বলছ?
বাড়ি যাও। দে আর ওয়েটিং।
হু দি হেল?
পুলিশ।
বাড়ি ফিরে দেখে, সরলাকে তখনও নিয়ে যায়নি। থানার ওসি এবং কয়েকজন পুলিশ অফিসার গম্ভীর মুখে অপেক্ষা করছেন। শোয়ার ঘরে কড়া পাহারায় নতমুখী সরলা।
কী হয়েছে?
শি ওয়াজ ইন আওয়ার লিস্ট।
হোয়াট লিস্ট।
স্যার, এ মেয়েটির সঙ্গে সুরিন্দরের গ্রুপের কানেকশন আছে। ওপেন অ্যান্ড শাট কেস। আপনি ফাইল ঘাঁটলেই দেখতে পাবেন। ফরগেট দা ম্যারেজ স্যার। ইট ওয়াজ এ কনসপিরেসি টু পাম্প আউট ইনফরমেশনস ফ্রম ইউ।
বিশ্বরূপ চেঁচাতে গিয়েও হঠাৎ স্থিতধী হয়ে গেল। শান্ত হল। তার মস্তিষ্ক কাজ করতে লাগল হঠাৎ। বাধা দিল না। পুলিশ সরলাকে নিয়ে গেল।
পরদিন সুপিরিয়র ডেকে পাঠালেন বিশ্বরূপকে। গম্ভীর মুখ। প্রশ্ন করলেন, একজন দায়িত্বশীল পুলিশ অফিসার কী করে এতটা ইডিয়ট হতে পারে বিশ?
সারা রাত ঘুমোয়নি বিশ্বরূপ। মুখ সাদা, শরীরে জ্বোরো ভাব। কথা বলতে পারল না।
শি ওয়াজ অন দি লিস্ট। মাত্র একমাসের পরিচয়ে মেয়েটাকে তুলে নিলে ঘরে? তোমার ম্যারেজ সার্টিফিকেটের কপি আনিয়েছি, দেখেছি চারজন সিভিলিয়ান তাতে সই করেছে সাক্ষী হিসেবে। যদি একজনও কলিগকে ডাকতে বিয়েতে তাহলেও হয়তো আটকানো যেত।
আমি বিয়ের পর একটা পার্টি দিয়েছিলাম। তাতে কলিগরা ছিল স্যার। তারা তখন সরলাকে দেখেছে।
সুপিরিয়র একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, কী দেখেছে বিশ? তোমার বউ সেদিন বিউটি পারলারে গিয়ে হেভি মেক-আপ নেয়, আইব্রো বদলায়, লিপ-লাইন বদলে ফেলে, টায়রা, নাকছাবি, নাকের গয়না, উইগ সবই সে ব্যবহার করেছিল। তুমি প্রেমে অন্ধ হয়ে লক্ষ করোনি।
বিশ্বরূপ মাথা নত করেছিল।
হেল অফ এ ম্যারেজ!
বিশ্বরূপের তখন নিজেকে পরাস্ত, বিধ্বস্ত, নিঃশেষ বলে মনে হয়েছিল।
তারপর চলল জেরা আর জেরা। পুলিশ হেফাজতে অন্তহীন জেরা, মনস্তাত্ত্বিক চাপ আর ভয়। ওরা দু’দিনের মধ্যে সরলাকে ভেঙে ফেলল। গলগল করে বেরিয়ে এল তথ্য। তারপর আরও তথ্য। তারপর ধীরে ধীরে অসংলগ্ন কথাবার্তা। তারপর প্রলাপ।
বিশ্বরূপ তাকে জেরা করার অনুমতি চেয়েছিল। সুপিরিয়র বলেছেন, বেটার নট। ওর আর কিছু বলার নেই।
একবার যদি দেখা করি।
বেটার নট। ফরগেট ইট লাইক এ ব্যাড ড্রিম।
কতখানি ভালবাসা ছিল সরলার, আর কতটাই বা অভিনয় সেটা মেপে দেখা হল নাবিশ্বরূপের। সন্ত্রাসবাদীরা ওর কাছ থেকে কতটুকু জেনেছে তা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। বিশ্বরূপের। ওদের অনেক চ্যানেল আছে। সব খবরই পৌঁছে যায়।
শুধু মালহোত্রা একদিন বলল, সুপিরিয়র একটা গাধা।
কেন বলো তো!
মেয়েটাকে অ্যারেস্ট করার মানেই হয় না।
বিশ্বরূপ চমকে উঠে বলে, তার মানে? ইজ শি ক্লিন?
আরে না ভাই, ক্লিন নয়। তবে আমরা ওকে তোমার বউ হিসেবে আরও এফিসিয়েন্টলি ব্যবহার করতে পারতাম। কাউন্টার-এসপিওনেজে। ও আমাদের ভাইটাল কানেকশন হয়ে উঠতে পারত। এরা যে কেন সবসময়ে হাল্লা মাচিয়ে কাজ বিলা করে দেয় কে জানে! তুমি কখনও ওর হ্যান্ডব্যাগ বা জিনিসপত্র দেখেছ খুঁজে?
না তো!
শি হ্যাড এ গান। সবুজ সুটকেসটার তলায় পাওয়া গেছে।
বিশ্বরূপ শিহরিত হল।
আশ্চর্যের বিষয় সরলা অ্যারেস্ট হওয়ার পর ওর আত্মীয়স্বজন কেউ এগিয়ে এল না। ওর যে পিসিকে আবছা চিনত বিশ্বরূপ সেও অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়। বাস্তবিকই গোটা ঘটনাটা দুঃস্বপ্নের মতোই অলীক মনে হতে লাগল।
একটা মেন্টাল হোম-এ পুলিশ হেফাজতে এখনও বেঁচে আছে সরলা। তবে সম্পূর্ণ উন্মাদ। চেঁচায়, কাঁদে, হাসে। বিশ্বরূপ কখনও তার সঙ্গে আর দেখা করেনি। তিনমাসের একটা সুখকর স্মৃতিকে কি বিসর্জন দিতে পারে সে? তার সুপিরিয়র বলেছিলেন, ফরগেট ইট লাইক এ ব্যাড ড্রিম। কথাটার কোনও যুক্তি নেই। এই ক্ষণস্থায়ী জীবনে সুখ-দুঃখের স্থিতি কী? ওই তিনমাস যদি অভিনয়ও করে থাকে সরলা তাতেই বা কী ক্ষতি? ঘরে ঘরে স্বামী-স্ত্রী, বাপ-ছেলে, মা-মেয়ে কি এরকম অভিনয় মাঝে মাঝেই করে না? মানুষে মানুষে অবিরল অনাবিল ভালবাসা বলে কি কিছু আছে? কাজেই বিশ্বরূপ তার বিপজ্জনক, অস্থায়ী এই জীবনে পদ্মপত্রে জলের মতো ওই টলটল করা তিনটে মাসের সুখ তার ভিতরে বন্দী করে রেখেছে। ওপরওয়ালার আদেশ সত্ত্বেও ভোলেনি। উন্মাদিনী সরলার কাছেও যায়নি ওই একই কারণে, মহার্ঘ তিনমাসের সৌন্দর্য ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।