বিশু ভারী অবাক হয়ে বলে, এ মা! তুমি ছেলে হবে কেন? ছেলে হলে তোমাকে বিচ্ছিরি লাগবে যে! ছেলেদের যে গোঁফ-দাড়ি হয়, ছোট করে চুল ছাঁটে, আর মোটা গলায় কথা বলে!
রুকুদি হেসে ফেলেছিল, তাতে কী? তবু তো বাবা খুশি হত। আমরা সাত বোনে মিলে বাবার জন্য কত করি বল তো! সারাক্ষণ ঘিরে থাকি, বাতাস করি, ঘামাচি মেরে দিই, পিঠে সুড়সুড়ি দিই, একটুও বায়না করি না। তবু…।
জলভরা চোখ, গলায় কান্নার কাপন, রুকুদি চুপ করে যায়।
বিষণ্ণতা একদম সহ্য হয় না বিশুর। চোখের জল, মুখ ভার, উদাস ভাব এসব তার দু’ চোখের বিষ।
এক-এক দিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে বিশু শুনতে পায়, মাতাল হরিদাস কাঁদে। ঘুনধুনে বুকভাঙা কান্না। বিশুর দাদু মাঝে মাঝে দুঃখ করে বলেন, লিভার পচে যখন গন্ধ বেরোবে তখন বুঝবে বাবা। মাতাল হরিদাসকে এমনিতে বিশুর খুব ভাল লাগে। মোটাসোটা শান্ত মানুষ। ভীষণ ঠান্ডা, কম কথা বলে। সব সময়ে মুখে একখানা হাসি-হাসি ভাব। লোকে বলে, যখন মদ না খায় তখন হরিদাসের মতো মানুষ হয় না।
কিন্তু কাঁদে কেন হরিদাস? কীসের দুঃখ? তার তিন কুলে কেউ নেই। সে দিব্যি ধানকলে কাজ করে আর খায়-দায়। তবে দুঃখ কীসের? একদিন সকালে হরিদাস বাখারি বেঁধে নিজের ঘর মেরামত করছিল। এইসব হাতের কাজ দেখতে বিশু বড় ভালবাসে। যেখানে যা হয় সে সব গিয়ে দেখে আসে। বেড়া বাঁধা, কুয়ো খোঁড়া, চিড়ে কোটা। সব। তার দিয়ে বাখারি বাঁধতে বাঁধতে হরিদাস দেওঘরে তিলকুট খাওয়ার গল্প করছিল। তিলকুট খাওয়ার গল্পটা একটুখানি, কিন্তু হরিদাস তা এমন বাখনাই করে বলে যে, হাঁ করে শুনতে হয়। গল্প করতে বসলে হরিদাস একেবারে মেতে যায়। তখন এক ফাঁকে বিশু বলল, আচ্ছা হরিকা, তুমি মাঝে মাঝে কাঁদো কেন?
মাতাল হরিদাস কথাটা নিয়ে একটু ভাবল। তারপর খুব করুণ মুখ করে বলল, ওই তো হল মুশকিল। ছাইভস্মগুলো খেলেই যে আমার সব কষ্টের কথা মনে পড়ে।
তোমার আবার কষ্ট কীসের?
আমার নিজের কষ্টের কথা ভাবি না। দিব্যি আছি, খাইদাই ঘুরে বেড়াই। কিন্তু পেটে ওই খারাপ জিনিসগুলো ঢুকলেই গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। কাল রাতেই তো এক কাণ্ড। সেই যে নিতাই পোড়েলের তিন বছরের বাচ্চাটা রেলে কাটা পড়ে মরল গত বছর জষ্টি মাসে, হঠাৎ তার কথা মনে পড়ে এমন কাদলুম যে বুক ভেসে গেল। অনেক মানত-টানত করে কত কষ্টে হয়েছিল বাচ্চাটা। সাতবেড়ের শিবমন্দিরে মানতের পুজো দিয়ে ফেরার পথে বোনের বাড়িতে দু’দিন থাকবে বলে এসেছিল। তা বোনের বাড়ি রেললাইনের গায়ে। নিতাই পোড়ড়ল ভগ্নিপতির সঙ্গে বেরিয়েছে, তার বউ আর বোন বসে গল্প করছে, বাচ্চারা বাইরে কোথায় খেলছে। এমন সময় ট্রেনের ঘন ঘন বাঁশি আর গেল-গেল ধর-ধর চিৎকার। মা-টা যখন পাগলের মতো ছুটে গেল তখন সব শেষ। খেলতে খেলতে কখন রেললাইনের। ধারে নুড়ি কুড়োতে চলে গিয়েছিল বাচ্চারা। বোনের বাচ্চারা সেয়ানা, তারা রেললাইনের ধারেই মানুষ। কিন্তু নিতাইয়ের বাচ্চাটা তো তা নয়। সময়মতো সরে আসতে পারেনি। কাল রাতে সেই পুরনো ঘটনাটা কেন যে মনে পড়ল এত। ভাবছিলুম, নিতাইয়ের বউটি যদি অত অসাবধান না হত যদি সামলে রাখত তা হলে বাচ্চাটা আজও বেঁচে থাকত। এই সব আবোল তাবোল কত কী মনে পড়ে। সকালবেলায় বসে বসে ভাবছিলুম, আমি খুব আহাম্মক, নইলে কোথাকার কে নিতাই পোড়েল, তার বাচ্চা সেই কবে ফৌত হয়ে গেছে, তারাও এখন হয়তো ভুলেটুলে গিয়ে দিব্যি হাসছে খেলছে গল্প করছে, তবে আমি কেন কেঁদে পরলুম! কিছু ভেবে পাই না।
বিশুর চোখ একটু ছলছল করছিল। তারও কেন কষ্ট হচ্ছে তা হলে অচেনা অজানা একটা বাচ্চার জন্য?
হরিদাস হাতের কাজ থামিয়ে খানিকক্ষণ আকাশমুখো চেয়ে থাকতে থাকতে বলল, দুনিয়ার জন্য আমার অনেক কিছু করার ছিল, বুঝলে! কিছুই করিনি। ভগবানের দান এই জীবন, ভগবানের দুনিয়াটার জন্যই কিছু করা হল না তো, সেই সব পাপ রাতের বেলা মনের মধ্যে ঘুলিয়ে ওঠে। তখন বড় কষ্ট হয়। সেই কবে এতটা এই তোমার বয়সি ছেলেকে দেখেছিলুম, পটলের দোকানের সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে পাউরুটি দেখছে। বোধ হয় খুব খাওয়ার ইচ্ছে। একবার মনে হল বলি, ও খোকা খাবি পাউরুটি? খা না। আমি পয়সা দেব’খন। তা অবিশ্যি শেষ অবধি আর বলিনি। মাঝে মাঝে মাতাল হলে সেই ছোঁড়াকে দেখতে পাই যেন। আহা, বোধহয় খিদে পেয়েছিল খুব, আমার পকেটে পয়সাও ছিল, কেন যে দিলুম না। আর তো তাকে খুঁজে পাব না, লাখোঁজনের ভিড়ে কোথায় হারিয়ে গেছে। এখন মনে পড়ে আর খুব কষে কান্না আসে। আমার হল ওই বিপদ।
বিশু বলে, আমারও তোমার মতো হয় হরিকা।
হরিদাস আহ্লাদের গলায় বলে, খুব ভাল। ভগবানের দুনিয়ার জন্য কিছু করে যেতে হলে ওইটে চাই। তবে আমার তো এমনিতে হয় না। মাতাল হলেই শুধু হয়।
মাতাল হলে কেমন লাগে তা তো জানে না বিশু। বড় হলে সে একবার মাতাল হয়ে দেখবে।
তবে সে এটা বেশ বুঝতে পারে যে, ভগবান যেমন অনেক কিছু দেন, তেমনি অনেক কিছু দেনও না।
নয়নখ্যাপাকে ভগবান দিয়েছেন ফুর্তি আর অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ। নয়ন হাটখোলার গাছতলায় বসে খুব হাঃ হাঃ করে হেসে ওঠে আর চেঁচায়, তেজাং গোলি! তেজাং গোলি! আকুড়কুড় তেজাং গোলি…