মৃদু একটু হাসল বিশ্বরূপ। কিছু বলল না। এ মহিলা রোমান্টিক। এঁর এখনও জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞতাই হয়নি।
আপনি পুলিশ কেন হলেন বলুন তো? অন্য চাকরি জুটল না?
বিশ্বরূপ একটু হাসে, আপনার কি পুলিশের ওপর রাগ আছে?
না, তা নয়। পুলিশকে তো আমাদের ভীষণ দরকার হয়। তবে চাকরিটা কি ভাল? একটু কেমন যেন, না?
বোধহয়। তবে আমার এটাই জুটেছিল। চাকরি বাছাবাছি করার উপায় তো ছিল না। তখন বড্ড খিদে পেত।
আমার হাজব্যান্ড বলছিল আপনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন।
পুলিশের চাকরিতেও মেধার দরকার হয়।
যাঃ। পুলিশের চাকরি তো চোর-ডাকাত ধা। আর কী? আর ট্র্যাফিক কন্ট্রোল, আর বোধহয় মব ভায়োলেন্স আটকানো। এসবের জন্য মেধার আবার কী দরকার মশাই?”।
বেঁচে থাকতে গেলেও মেধার দরকার হয়। নইলে মরতে হয়। একটু শক্ত কাজ।
আপনাকে দেখে কিন্তু একটুও পুলিশ মনে হয় না। বরং ভাল লোক বলে মনে হয়। বিশ্বরূপ কখনও জোরে হাসে না। এখনও হাসল না। স্মিত মুখে বলল, পুলিশ তা হলে ভাল লোক নয়?
অপ্রতিভ বকুল বলে, ঠিক তা বলিনি। চাকরিটা একটু রাফ গোছের লতা। একটু র’। তাই? আপনাকে যেন মানায় না।
বিশ্বরূপ নিজের করতলের দিকে চেয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বোধহয় ঠিকই বলেছেন আপনি।
রাগ করলেন না তো!
রাগ! না। রাগ আমার খুব কম হয়।
খুন-টুন করেননি তো? মানে, পুলিশকে তো অনেক সময় দুষ্টু লোককে গুলি-টুলি করতে হয়।
বিশ্বরূপ এ কথাটারও জবাব দেয় না।
তাকে চুপ করে থাকতে দেখে বকুল বলে, তার মানে করেছেন। উঃ, কী করে যে একজনকে আর-একজন খুন করে, তা সে হোক না চোর বা ডাকাত!
বিশ্বরূপ মৃদু-মৃদু হেসে বলে, আপনার মেয়েকে আপনি খুব ভালবাসেন তো?
ও বাবা, ওকে ছাড়া কিছু ভাবতেই পারি না আজকাল। আমার দিনরাত্তির তো ওই ভরে রাখে।
ধরুন আপনার মেয়েকে যদি কেউ কিডন্যাপ করে আর মেরে ফেলার ভয় দেখাতে থাকে?
বকুল স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে বিশ্বরূপের দিকে। তারপর হঠাৎ বলে, বুঝেছি। পুলিশ কেন খুন করে কিংবা আপনি কেন খুন করেন সেটাই বোঝাচ্ছেন তো?
বোঝা মোটেই শক্ত নয়। তবে ওসব নিয়ে না ভাবাই ভাল। আপনাদের জীবন অন্যরকম।
আর আপনারটা?
বিশ্বরূপ মাথা নেড়ে বলে, ঠিক বুঝতে পারি না। আমি হলাম খড়ের পুতুল। কে যেন চালায় আড়াল থেকে।
আপনি কীরকম পুলিশ? বাবু-পুলিশ না কেজো-পুলিশ?
দু’রকম আছে নাকি?
ওর এক বন্ধু আছে। লালবাজারে। সে কোনও অ্যাকশন-ট্যাকশন করেনি কখনও। ভাল তবলা বাজায় আর বই পড়ে। সে বলে সে নাকি বাবু-পুলিশ। আপনি?
আমি কেজো। বিশেষ ধরনের কেজো।
স্পেশাল ব্রাঞ্চ?
আপনি অনেক জানেন দেখছি। হ্যাঁ, স্পেশাল ব্র্যাঞ্চ।
আপনার কাজটা বোধহয় বিপজ্জনক, তাই না?
ইট ডিপেন্ডস। বর্ধমান এসে গেল কিন্তু। জল-টল লাগবে?
আপনি আজ তিনবার আমাদের ওয়াটার বটল ভরে দিয়েছেন। ছিঃ ছিঃ, যা লজ্জা করেছে আমার। আমার হাজব্যান্ডটি একদম স্মার্ট নয় যে! লেখাপড়া-জানা, মায়ের আদুরে ছেলে।
মেয়েটির বয়স তার মতোই হবে, অনুমান করল বিশ্বরূপ। পঁচিশ-ছাব্বিশ। আদুরে এও কম নয়।
আপনার রান্না কে করে দেয়?
লোক আছে। মাইনে করা লোক।
বিশ্বাসী?
পুলিশকে সবাই একটু সমঝে চলে।
ওঃ, তাও তো বটে। ভুলেই গিয়েছিলাম। পুজোর মাসখানেক আগে আমাদের একটা কাজের মেয়ে সব চুরি করে পালিয়ে গেল। পাশের ফ্ল্যাটের ঝি এনে দিয়েছিল দেশ থেকে। খাওয়া-পরার লোক। বেশ কাজেরও ছিল। পালাল। পাশের বাড়ির ঝিটাও কাজ ছেড়ে দিয়েছে এ ঘটনার আগেই। ওদের গায়ের নামটা অবধি ভুলে গেছি। পাঁচ ভরি সোনা, ঘড়ি, জামা-কাপড়, অনেক বাসন আর আমার কিছু কসমেটিকস। পুলিশ কিছু করতে পারল না। বলল, অজ্ঞাতকুলশীলকে রাখা ঠিক হয়নি, তোক রাখতে হলে আগে থানায় এনে নাম-ধাম এন্ট্রি করে রাখতে হয়। তাই নাকি?
হবে হয়তো।
আপনার বাড়িতে তো চুরির বা ডাকাতির কোনও ভয় নেই, না?
বিশ্বরূপ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, তার চেয়েও বেশি ভয়ের ব্যাপার থাকতে পারে। সত্যিই জল বা চা কিছু চাই না তো?
না। জল আছে। এখন শুধু চাই বাড়ি ফিরে নিজের ঘরদোর আর নরম বিছানা। ক’টায় পৌঁছোব বলুন তো?
রাত দেড়টা নাগাদ।
আপনার গাড়ি সত্যিই থাকবে তো! না কি রাত বেশি হলে ফিরে যাবে?
থাকবে। চিন্তা করবেন না।
আমাদের পৌঁছে দিয়ে আপনার তো হোটেলে ফিরতে আরও রাত হবে। আমাদের ফ্ল্যাটটা কিন্তু বেশ বড়, তিনটে বেডরুম। আপনি ইচ্ছে করলেই থাকতে পারেন।
বিশ্বরূপ মাথা নাড়ে, আপনি বাড়ি ফিরছেন, কিন্তু আমি বাড়ি ফিরছি না। গন্তব্যটাই জানি না এখনও। হোটেলের কথা বলেছিলাম বলে ভাববেন না সেখানেই যাব। হয়তো যাওয়া হবেই না।
আপনি কি কোনও মিশনে যাচ্ছেন? অন ডিউটি?
হ্যাঁ। অন ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট সারভিস।
আপনি যাকে বিয়ে করবেন সে বেচারার ভারী দুর্ভোগ আছে কপালে।
বিশ্বরূপ মাথাটা কোলে আর-একটু নামিয়ে নিল।
সরলার সঙ্গে দেখা হয়েছিল এক পার্টিতে। অন্য মেয়েদের মত ঝলমলে নয়, বরং সিরিয়াস এবং চুপচাপ। কে যে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল আজ আর তা কিছুতেই মনে পড়ে না। সব পার্টিতেই কিছু উটকো লোক আসে, স্মার্ট রসিক বাকচতুর এবং শিকড়হীন। ওরকমই কেউ হবে। আলাপ সামান্য, কিন্তু খুব গভীরভাবে তার দিকে তাকিয়ে থেকেছিল সরলা।