বিশ্বরূপ সিটে ফিরে এল। বকুল উঠে বসল উলটোদিকের সিটে। নিজের চুল ঠিক করতে করতে হঠাৎ বলল, আচ্ছা, এত রাতে আপনি কোথায় গিয়ে উঠবেন?
বিশ্বরূপ সামান্য অবাক হয়ে বলে, আমি! ওঃ। আমার জন্য কোনও হোটেলে একটা রুম বুক করা আছে।
হোটেলে কেন? কলকাতায় আপনার কোনও আত্মীয় নেই?
না।
আত্মীয়রা সব কোথায়? দিল্লিতে বুঝি।
না। আমার তেমন আত্মীয় বলতে কেউ নেই।
শ্বশুরবাড়ির আত্মীয় তো আছে!
বিশ্বরূপ সামান্য হাসল, আমার বউ বা শ্বশুরবাড়িও নেই।
আপনার তো সবই নেই দেখছি।–বলে বকুল একটু হাসল, তা হলে আছেটা কী?
স্মৃতি আছে। আর আছে কাজ।
ভাইবোন ছিল না আপনার?
না। আমি বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।
বকুল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, খুব আদরের ছিলেন বুঝি! এখন তো যত্ন করার কেউ নেই, কষ্ট হয় না?
না। কষ্ট কেন হবে?
আমি তো বারো বছর বয়স অবধি মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিলাম। তখন আদরটাকে মাঝে মাঝে অত্যাচার বলে মনে হত। গুচ্ছের খাবার গিলতে হত জোর করে, গাদা গাদা জামাকাপড় খেলনায় আমার যেন দম বন্ধ হয়ে আসত, একটু অসুখ হলেই দু’জন-তিনজন ডাক্তার চলে আসত, ওষুধ খেয়ে খেয়ে ড্রাগ-অ্যাকশন হয়ে আমার নর্মাল স্বাস্থ্যই নষ্ট হতে বসেছিল। প্রাইভেট পড়ানোর জন্য তিনজন মাস্টারমশাই আর দু’জন দিদিমণি ছিলেন। গানের স্কুলে যেতে হত, ব্যায়ামের স্কুলে যেতে হত, আঁকা শিখতে যেতে হত। একা আমাকে যে কত কিছু করতে চেয়েছিল আমার মা আর বাবা। বারো বছর যখন আমার বয়স তখন হঠাৎ আমার দু’টি যমজ ভাইবোন হয়। ওরা হওয়ার পর আমার ওপর থেকে অ্যাটেনশন সরে গিয়ে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আপনারও কি সেরকম ছিল?
বিশ্বরূপ মাথা নেড়ে স্মিতমুখে বলে, না। আমরা ছিলাম গরিব রিফিউজি। বনগাঁর কাছে একটা গাঁয়ে থাকতাম। আদরটা ঠিক আপনার মতো টের পাইনি। তবে
থেমে গেল বিশ্বরূপ। বললে এ মেয়েটা বুঝবে না। সে কী করে বলবে যে, তাকে আদর করত শরতের নীল আকাশ, দিগন্ত থেকে ছুটে আসা বাতাস, রাতের নক্ষত্র, মাঠের ঘাস, জ্যোৎস্নারাতের পরি। তাকে আদর করত জোনাকি পোকা, ঝিঁঝির ডাক, কালো পিঁপড়ে। তখন ভগবান ছিল। মা ছিল। দাদু ছিল। বাবা ছিল। রুকুদি ছিল।
সেই গাঁয়ে কেউ নেই এখন?
না। কেউ নেই।
বাড়িটা?
ঠোঁট উলটে বিশ্বরূপ বলে, সামান্য টিনের ঘর। হয়তো উড়ে-পুড়ে গেছে। আমি আর যাই না।
কেন যান না? শত হলেও দেশ তো! আমাদেরও যশোরের কোথায় যেন দেশ ছিল। মা-বাবা সারাক্ষণ দেশের কথাই বলে। আমি জন্মাই কলকাতায়। দেশ নেই বলে খুব খারাপ লাগে।
কেন, কলকাতাই তো আপনার দেশ!
মোটেই না। কলকাতাকে কক্ষনও দেশ বলে মনে হয় না।
কেন মনে হয় না? কলকাতার কী দোষ?
কী জানি কেন! থাকতেই ভাল লাগে না। এ যেন অন্যের শহর। আমরা কেমন যেন। ভাড়াটে-ভাড়াটে হয়ে আছি।
বিশ্বরূপ অর্থহীন ফ্যাকাসে হাসি হাসল।
মাটির গন্ধ না থাকলে কি কোনও জায়গা আপন হয়, বলুন? আমার খুব ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে গাঁয়ে গিয়ে থাকতে। মাটির ঘর করব, বেশ বড় একটা বাগান থাকবে, তাতে অনেক গাছপালা। আমার গাছপালার ভীষণ শখ। আমার হাজব্যান্ডকে কত বলি, ও শুনে কেবল চটে যায়। বলে, দূর দুর, গাঁয়ে আজকাল ভীষণ পলিটিকস, থাকতে পারবে না। কত বুঝিয়ে বলি যে, আমরা তো সবসময় থাকতে যাচ্ছি না, মাঝে মাঝে গিয়ে থাকব। কতই বা খরচ হবে গাঁয়ে মেটে বাড়ি করতে? ও বলে, ও বাবা, না থাকলে সব বেদখল হয়ে যাবে। আচ্ছা, আপনাদের গ্রামটা কেমন ছিল?
বিশ্বরূপ ব্যথাতুর মুখে শূন্যের দিকে চেয়ে ছিল। অবশ্য সামনে শূন্য বলে কিছুই নেই। একটা আবদ্ধ কামরায় লটবহর, মানুষজন। তবু হঠাৎ কামরাটা অদৃশ্য হয়ে গেল চোখ থেকে। সামনে জলভরা বর্ষার মাঠ। সেদিন বাড়িতে রান্নাই হয়নি। একপেট খিদে নিয়ে কাগজের নৌকো ভাসাচ্ছিল বিশু। তার তিনটে নৌকোর কোনওটাই শেষ অবধি সোজা হয়ে ভেসে রইল না। কেতরে পাশ ফিরে রইল। তারপর ঝমঝম বৃষ্টিতে ডুবেই গেল হয়তো। বর্ষার মাঠের ধারে একটু ভাঙা জমিতে কাকের মতো ভিজতে ভিজতে বসে রইল বিশু। পেটের খিদে থেকে রাগ উঠে আসছে মাথায়। এই বৃষ্টিতে কাগজের নৌকো কি ভাসে? ভাসে না, বিশু জানে। কিন্তু কেন রাগ হচ্ছিল? রাগের চোটে সে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল তিড়িং করে। তারপর আর কী করে? রেগে গিয়ে সে কী করে পৃথিবীকে জানান দেবে। তার রাগ? সে হঠাৎ দুই হাত ক্ষিপ্তের মতো ওপরে তুলে জলে নেমে শুধুই লাফাতে লাগল আর চেঁচাতে লাগল, কেন? কেন! কেন এরকম হবে? কেন সবসময়ে এরকম হবে? উদ্বাহু সেই নৃত্যের না ছিল মাথা, না ছিল মুন্ডু। লাফাতে লাফাতে নাচতে নাচতে কেমন ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছিল তার মাথা, চোখ আবছা হয়ে আসছিল বৃষ্টির জলে আর অশ্রুতে। রাতে স্বপ্নের ভিতরে তার তিনটে নৌকোই ফিরে এল সাজ বদল করে। পালতোলা মস্ত কাঠের নৌকো তরতর করে উজিয়ে আসছিল তার কাছে।
বিশুর ভগবান ছিল। বিশ্বরূপের নেই।
বিশ্বরূপ তার ঈষৎ ভাঙা ধীর কণ্ঠস্বরে বলে, কেমন আর ছিল। আর-পাঁচটা গাঁয়ের মতোই। খুব গরিব গাঁ। কিছুই তেমন ছিল না সেখানে। বন্যা হত, খরা হত, চাষে পোকা লাগত। বর্ষাকালটা ছিল আকালের ঋতু। কতদিন খাওয়া জোটেনি আমাদের।
আহা রে! পথের পাঁচালী পড়তে পড়তে আমি তো কত কাদি। কী সাংঘাতিক লেখা, না? কী ভীষণ গরিব ছিল ওরা।