পাটনায় এসে সে পীতাম্বর মার্ডার কেসের ওপর সংগৃহীত তথ্যাবলী সহ স্টোরি খাড়া করল। মুখপাত্র হিসেবে রইল পীতাম্বরের অসম্পূর্ণ লেখাটা। পরপর কয়েকদিন ধরে বেরোল রংদার কাহিনিটি।
নিউ পাটনা টাইমস ডুবতে ডুবতেও যেন প্রবল বিক্রমে ভেসে উঠতে লাগল। রাতারাতি সার্কুলেশন বেড়ে গেল দশ হাজার। রঙ্গনাথের মুখে হাসি। অথচ লোকটা একসময়ে পীতাম্বরের বন্ধু ছিল। এখন পীতাম্বর এঁর কাছে শুধু একটা গরম খবর মাত্র। আর কিছু নয়। পীতাম্বরের খুনের খবর স্কুপ করতে পারায় এ লোকটা দারুণ খুশি হয়ে তার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন!
অজিত শিউরে উঠে ভাবে, আমিও কি ওরকম হয়ে যাব? ওরকম হৃদয়হীন, স্বার্থপর?
রঙ্গনাথ একদিন তাকে ডেকে বললেন, শোনো অজিত, নিউ পাটনা টাইমসের একটা হিন্দি এডিশন বের করার পারমিশন চেয়ে আমি অনেক আগেই একটা দরখাস্ত করেছিলাম। পারমিশনটা এসে গেছে। বাজার গরম থাকতে থাকতেই আমি হিন্দি এডিশনটা বের করতে চাই। গেট রেডি ফর মোর ওয়ার্ক।
উইথ মোর পে স্যার?
রঙ্গনাথ ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তারপর হাসলেনও, অফকোর্স। তোমাকে ওভার অল ইনচার্জ করে দিচ্ছি। দুটো কাগজই দেখবে।
পীতাম্বর বরাবর তার উপকারই করে এসেছেন। পুত্রবৎ দেখতেন অজিতকে। মৃত্যুর ভিতর দিয়েও শেষ উপকারটাই করে গেলেন বোধহয়। অজিতের চোখ ঝাপসা হয়ে এল আবেগে।
পাটনার আই বি কালিকাপ্রসাদের সঙ্গে অজিতের খাতির অনেকদিনের। আগাগোড়া যোগাযোগ। কালিকা একদিন বলল, তুই ভাবতে পারিস, সুরিন্দর— শুধু সুরিন্দরের জন্যই একটা আলাদা সেল আছে স্পেশাল ব্রাঞ্চে? চারটে মোস্ট এফিসিয়েন্ট অফিসার দিনরাত মনিটর করছে ওর অ্যাকটিভিটি। সারা ভারতবর্ষে যেখানে সুরিন্দরের গন্ধ পায় সেখানেই ছুটে যাচ্ছে ওরা। ওদের সন্দেহ কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, পঞ্জাব থেকে অসম সারা দেশে একটা সন্ত্রাসের ঢেউ তুলে দিচ্ছে ওই একটা লোক। ওকে ধরতে পারলে অবশ্য ধরা কথাটা নিতান্তই কথার কথা আসলে মারতে পারলে সরকার হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।
০৪. বিশু চমকে উঠল
॥ চার ॥
বিশু! ওঠ, ওঠ। খাবি না? ভাত জুড়িয়ে যাচ্ছে যে বাবা! আয় আমি খাইয়ে দিই।
বিশু চমকে উঠল। তারপর ধীরে চোখ খুলল বিশ্বরূপ। মা নেই, বাবা নেই, দাদু নেই, কেউ নেই। কেউ কোথাও নেই। মাঝে মাঝে এক অচেনা জগতের মধ্যে জেগে ওঠে বিশ্বরূপ। এরা কারা? এ কোথায় এল সে?
রাত বারোটার কাছাকাছি। ট্রেন এখনও বর্ধমানে পৌঁছোয়নি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, ধৈর্যহারা যাত্রীরা গা ছেড়ে দিয়েছে। জল ফুরিয়েছে, খাবার নেই। শুধু ক্লান্তি আছে, আর বিরক্তি, আর রাগ। নিল রাগ। উলটোদিকের স্বামী আর স্ত্রীতে স্বাভাবিক বনিবনা নেই, ট্রেনের গর্দিশে মেজাজ আরও বিগড়ে গেছে। অন্তত চারবার চাপা ঝগড়া হয়েছে দু’জনের। এখন কথা বন্ধ। ভদ্রলোক বাঙ্কে শুয়ে ঘুমোচ্ছন। ভদ্রমহিলা নীচের সিটে মেয়ের পাশে শোওয়া, তবে ঘুমোচ্ছন কি না বলা শক্ত। একটু আগে বিশ্বরূপ দেখেছে, ভদ্রমহিলা তাকে চোরা চোখে লক্ষ করছেন। বেশ সুন্দরী, তবে বিলম্বিত ট্রেনের বিরক্তিকর এই যাত্রায় সৌন্দর্যটা ধরে রাখতে পারছেন না।
কামরায় এখন কোনও কথাবার্তা নেই। কথাও ফুরিয়েছে বোধহয়। ট্রেন আট ঘণ্টার ওপর লেট। স্টেশনে পৌঁছেও অনেকে বাড়ি যেতে পারবে না। খাবার পাবে না। লটবহর নিয়ে বসে থাকতে হবে প্ল্যাটফর্মে। বেশিরভাগ লোকেরই আর নতুন করে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। প্রতিবাদ নেই। প্রতিকার নেই। তারা অগত্যা ঢুলছে। তবু এরা ঘরে ফিরবে, যখনই হোক। ট্রেন লেট হওয়া ছাড়া আর তেমন কোনও বিপদ হবে না এদের।
বিশ্বরূপ বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে জল ছিটোল। এক ঝলক নিজের সিক্ত বিষণ্ণ মুখখানার দিকে তাকাল। লোকে বলে, এ মেলাঙ্কলিক ফেস। কেউ কেউ আড়ালে তাকে উইপিং অফিসার বলে উল্লেখ করে। নিজের মুখে কিছুই খুঁজে পায় না বিশ্বরূপ। তার কেবল একটা কথাই মনে হয়, সে এক সাজানো মানুষ। সে প্রতিপক্ষের উদ্যত অস্ত্রের সামনে এগিয়ে দেওয়া খড়ের পুতুল। সে এক অন্তহীন ক্যাসেট, যাতে অন্তহীন ক্রস-একজামিনেশন, অন্তহীন জেরা, অন্তহীন তথ্যাবলী রেকর্ড করা হয়। সে এক বিবেকহীন ভাড়াটে খুনি। মাস-মাইনের বিনিময়ে সে ফর ল অ্যান্ড অর্ডার অস্ত্র প্রয়োগ করে। তার নিশ্চিন্ত ঘুম বলে কিছু নেই, কানের কাছে ফোন রেখে পোশাক পরা অবস্থায় সে উৎকর্ণ হয়ে ঝিমোয় মাত্র। ফোন বাজলেই ছুটতে হয় এখানে সেখানে। রোবটের মতো দীর্ঘ রিপোর্ট টাইপ করে ফাইলবন্দি করতে হয় তাকে। মাঝে মাঝে একত্র হলে তারা চারজন। ক্লান্ত অফিসার চুপচাপ বসে থাকে। কথা আসে না। ভাব আসে না। পারস্পরিক সিগারেট বিনিময় পর্যন্ত ভুলে যায় তারা।
অ্যাসাইনড টু কিল! না কি অ্যাসাইনড টু বি কিলড! কে জানে কী। তবে বিশ্বরূপ জানে সে গুপ্তঘাতকের প্রিয় টার্গেট। কে আগে কাকে দেখতে পাবে তা ঈশ্বর জানেন। ঈশ্বর জানেন কে আগে গুলিটা চালাবে। ঈশ্বর জানেন কার টিপ আসল মুহূর্তে থাকবে কতটা নির্ভুল।
গৃহস্থদের কি হিংসা করে বিশ্বরূপ? একটু করে। ওরা বেশ নিজেদের নিয়ে মেতে আছে। এই যে শ্যামল, তার সুন্দরী স্ত্রী বকুল, শিশু মেয়েটি ট্রেন লেট হওয়া ছাড়া, বাড়ি পৌঁছোনো ছাড়া এদের কোনও সমস্যাই নেই। এদের চলার পথে কেউ এদের জন্য ওত পেতে অপেক্ষা করছে না।