বিস্বাদ মুখে, খিদে-তেষ্টা-ঘুমহারা অজিত ভজনা দেবীকে ফোন করল, মা, সরি।
একটু চাপা ধরা গলায় ভজনা দেবী বললেন, আমি ভবিতব্য মানি।
আমারই ভুল, লোকাল পুলিশকে আমারই অ্যালার্ট করে আসা উচিত ছিল।
কিছু লাভ হত না। পুলিশও এদের ভয় পায়। হয়তো পুলিশের আরও কিছু লোক মারা যেত। লালুয়াটাকে আমি কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিলাম। আর মহেন্দ্র–সেও তো কত ছেলেবেলায় আমার কাছে এসেছিল।
আপনার ওকে ডিভোর্স দেওয়া উচিত হয়নি মা। আপনি থাকলে এটা হতে পারত না।
কে বলল? যা হওয়ার ঠিকই হত। আমরা কি সবকিছু খণ্ডন করতে পারি?
মা, আপনি বড় ভাগ্যবাদী।
আমার বিজ্ঞান তাই বলে। কী করব বল!
পীতাম্বরের জন্য শোক— সে ত আছেই অজিতের। কিন্তু এ ঘটনার পিছনে স্টোরিটা কী? পীতাম্বর তাকে চোখ দিয়ে কিছু বলতে চেয়েছিলেন। ওই অসমসাহসী লোকটিও মুখ খুলতে সাহস পাননি। পীতাম্বরকে চেনে অজিত, তিনি মৃত্যুভীত ছিলেন না। কিন্তু ব্যক্তিগত মৃত্যুকে অনেক কাপুরুষও ভয় পায় না, ভয় পায় প্রিয় বা আশ্রিতজনের মৃত্যুকে। পীতাম্বরের ভয়ও কি তাই ছিল? মিঠিয়া, লালুয়া, মহেন্দ্র এদের বাঁচানোর জন্যই কি তিনি মুখ বন্ধ রেখেছিলেন? সেটাই সম্ভব। পীতাম্বর সবসময়েই বলতেন, আই লাভ মাই ফোকস। চেনাজানা মানুষ, বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী, দলের লোক বা অনুগামী সকলকেই তিনি সবসময়ে রক্ষা করার চেষ্টা করতেন।
স্থানীয় পুলিশ অজিতের কাছে মুখ খুলল অনায়াসেই। তার কারণ ঘটনাটা বেশ বড় ধরনের এবং তারা যথেষ্ট ভীত। এক ইন্সপেক্টর বললেন, ফোর মার্ডারস ইয়েস। বাট থ্যাংক গড দে আর আউট অফ আওয়ার হেয়ার।
এ কথা কেন বলছেন?
আরে ভাই, ওদের ট্যাকল করার মতো কী আছে আমাদের বলুন তো? ওই তো গাদা বন্দুকের মতো আদ্যিকালের সব ভারী বন্দুক, আর এরাটিক রিভলবার। আর ওদের কাছে সফিস্টিকেটেড এ কে ফর্টিসেভেন আর সাবমেশিনগান, যা দিয়ে আমাদের এখানকার পুরো পুলিশ ফোর্সটাকে উড়িয়ে দেওয়া যায়। এদের সঙ্গে লড়ার জন্য কী দিয়েছে আমাদের গভর্নমেন্ট! এনি ট্রেনিং? দু-চার দিন লেফট-রাইট করে ছেড়ে দিলেই হয়ে গেল? ওদের দেখুন, প্রত্যেকে কম্যান্ডো ট্রেনিং নিয়ে আসছে পাকিস্তান বা চিন থেকে। বিদেশেও ট্রেন আপ করা হচ্ছে। ফুল মিলিটারি ট্রেনিং। আমাদের এক্স-মিলিটারিমেনরাও ওদের ভিতরে রয়েছে। আমরা সিভিলিয়ানদের ট্যাকল করতে পারি, মব ভায়োলেন্সের মোকাবিলায় যেতে পারি, গুন্ডাবাজি সামলাতে পারি, বাট নট দিস টাইপ অফ অ্যাডভারসারিজ।
একটা কথা বলবেন?
কী কথা?
রিগার্ডিং পীতাম্বর মিশ্রজির ইয়ং ওয়াইফ। ওয়াজ শি রেপড?
মাই গড! নো স্যার। আমরা ও অ্যাঙ্গেলটা খুব ভাল করে দেখেছি। মিলিটান্টরা এ কাজ। বড় একটা করে না। মে বি দে হ্যাভ সাম আইডিয়ালস। তবে মার্ডারের তিন-চারদিন আগে আশেপাশের দুটো গ্রামীণ ব্যাংক লুটপাট এবং মার্ডার হয়েছে। লাখ খানেকের মতো টাকা গেছে। দুটো ব্যাংকেই আমরা এনকোয়ারি করেছি। কেউ মুখ খুলছে না। উলটোপালটা বলছে। অ্যাবসেলিউটলি টেরোরাইজড। এখন বুঝতে পারছি পীতাম্বর মিশ্রজির মার্ডারার আর ব্যাংক ডাকাত একই দল।
তারা ক’জন?
তিনজন?
টাকার অ্যাঙ্গলটার কথা মনে ছিল না অজিতের। সে এরপর পীতাম্বরের ব্যাংকে গিয়ে খোঁজ নিল। গত সপ্তাহে পীতাম্বর তার চারটে মোটা টাকার ফিক্সড ডিপোজিট ম্যাচুরিটির অনেক আগেই ভাঙিয়ে নিয়েছেন এবং তুলে নিয়েছেন সেভিংস অ্যাকাউন্টের প্রায় সব টাকা। সব মিলিয়ে লাখ দেড়েক তো হবেই।
মুংলি পীতাম্বরের তিনটে মোষের জন্য ঘাস কেটে এনে দিত। আর রতুয়া আসত খেউরি করতে। পীতাম্বরের খানাতল্লাসে তারা প্রথমটায় ভয় পেয়ে মুখ বুজে থাকলেও পরে যা জানাল তা হল, প্রায় এক মাস হল তিনটে গুন্ডা ধরনের লোক পীতাম্বরের বাসায় থানা গাড়ে। প্রথমটায় কিছু বোঝা যায়নি। পিছনের বাগানে পীতাম্বর ওদের সঙ্গে কয়েকদিন বন্দুক নিয়ে চাঁদমারি করেছিলেন। তারপর সব বন্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ একদিন ফটকে তালা পড়ে গেল। বাড়ি থেকে কেউ বেরোত না। মুংলি ঘাসের বোঝা নিয়ে গেলে ফটকের ওপর দিয়ে ভিতরে ফেলতে হত, লালুয়া তুলে নিয়ে যেত। রতুয়া অবশ্য ভিতরে ঢুকে খেউরি করে আসত, তবে সবসময়ে লক্ষ করত আশেপাশে কেউ না কেউ মোতায়েন আছেই!
তবে বাজারহাট করত কে?
ওই তিনজনেরই একজন। আর কেউ বাড়ির বাইরে আসত না। পীতাম্বরজি অবশ্য কয়েকবার বেরিয়েছেন, কিন্তু সঙ্গে ওদের কেউ থাকত।
তোরা পুলিশে খবর দিসনি কেন? বা
প রে! জানে মেরে দিত বাবু! ওসব বহুত খতরনাক আদমি।
পুলিশের অনুমতি নিয়ে একদিন পীতাম্বরের বাড়িতে ঢুকল অজিত। দু’জন কনস্টেবল পাহারায় ছিল, তাদেরই একজন বাড়ির দরজার তালা খুলে দিয়ে সাবধান করে দিল, জিনিসপত্রে হাত দেবেন না।
পিছনের ঘরটায় সেই ছোট সুটকেসটা খুঁজে দেখল অজিত। পাবে বলে আশা করেনি। পেলও না। বিপ্লবীর অস্ত্র হাতে পেয়েও পীতাম্বর নিজেকে বাঁচাতে পারেননি, অস্ত্রটাও যোগ্য হাতে ফিরে গেছে। পীতাম্বরের লেখাপড়ার টেবিলটা খুঁজল অজিত। ফুলস্ক্যাপ কাগজের দেড়খানা লেখা পৃষ্ঠা পেল। মনে হল, তাদের কাগজের জন্যই লিখতে শুরু করেছিলেন পীতাম্বর। এগোতে পারেননি। অজিত দেড়খানা পৃষ্ঠা চুরি করল অম্লানবদনে।