লোকটা খুব অবাক হল। তবে এল। বেশ আত্মবিশ্বাসে ভরপুর পদক্ষেপ। বেশ অহংকারী উচ্চশির গেরামভারী হাবভাব। মুখে হাসি-টাসি নেই। চারপাইয়ের ওপর সাবধানে বসে পলকহীন চোখে অজিতের দিকে চেয়ে রইল। জরিপ করছে। হিসেব করছে।
অজিতের একটা ইনটুইশন আছে। খুনি দেখলেই সে চিনতে পারে। কখনও ভুল হয় না। খুনির চোখে একটা আলগা চকচকে ভাব থাকবেই। সবাই বুঝতে পারে না, অজিত পারে। সে স্পষ্টই বুঝে নিল, এ লোকটা খুনি। পীতাম্বরের বাড়িতে এর জায়গা হওয়ার কথাই নয়। পীতাম্বরের বাড়ির জীবনযাত্রার একটা প্যাটার্ন আছে, তাতে এ ভীষণ বেমানান।
তার চেয়েও বড় কথা, মুখটা অজিতের চেনা। আবছা হলেও চেনা। কোনও ফোটোগ্রাফে সে এই মুখটা দেখেছে।
পীতাম্বর গুম মেরে গেছেন।
অজিত তরল গলায় হিন্দিতে বলে, আপনি মিশিরজির শ্বশুরবাড়ির মেহেমান শুনলাম। আমি অজিত, সামান্য সাংবাদিক।
লোকটা বিবেকানন্দের মতো বুকে আড়াআড়ি হাত রেখে দুর্দান্ত গমগমে গলায় বলে, ইহা ক্যা কাম হ্যায়?
অজিত মৃদু হেসে বলে, মিশিরজিকা সাথ কুছ কাম হ্যায়।
লোকটা অপমানজনক গলায় প্রায় ধমকে উঠল, তো ওহি কর লিজিয়ে।
পীতাম্বরের অস্বস্তি এরপরে বেড়ে গেল। অজিত সংকেতটা বুঝতে পারছে। কিন্তু পীতাম্বরের চোখ কী বলছে বা বলতে চাইছে সেটা বুঝতে পারল না। শুধু আন্দাজ করল পীতাম্বর সুখে নেই, সোয়াস্তিতে নেই, পীতাম্বর ভয় পেয়েছেন, চাপের মধ্যে আছেন।
অজিত উঠল। স্বাভাবিক গলায় বলল, আজ চলি মিশিরজি। আমাদের লেখাটার কথা মনে রাখবেন। সপ্তাহে একটা। পার আর্টিকেল আমরা দুশো টাকা করে দেব।
ভেবে দেখব। এখন যাও। ঠিকমতো কাম কাজ করো। হুশিয়ারসে। রঙ্গনাথকে বোলো আমরা ভাল আছি। ভজনাকেও বোলো।
পীতাম্বরের পুরো কথাটাকেই কেন সংকেতবাক্য বলে মনে হল অজিতের? যখন চলে আসছিল তখন শুনতে পেল, লোকটা পীতাম্বরকে জিজ্ঞেস করছে, হু ইজ হি?
লাইক মাই সনা—পীতাম্বর বললেন।
পাটনায় ফিরে অজিত সোজা অফিসে চলে গেল। তখন অনেক রাত। নাইট শিফট চলছে। অজিত তার কাগজ এবং অন্যান্য কাগজের পুরনো ফাইল নিয়ে বসল। বেয়ারা হবিবুরকে বলল, টেররিস্টদের ফোটোর ফাইলটা বের করে আনো।
প্রায় সারা রাত ফাইল ঘাঁটল অজিত। ভোরের দিকে একটা ফোটোগ্রাফ খুঁজে বের করল। পিছনে একটা ট্যাগ লাগানো। বেশ বড় ট্যাগ। সুরেন্দ্র ওরফে হরমিক সিং ওরফে বুক্কা ওরফে নাম সিং… অনেক নাম। সাসপেকটেড কিলার অফ… খুনের তালিকাটাও বেশ বড়। বেসড ইন কানাডা। সঙ্গে সবসময়ে দু’জন বা তিনজন সঙ্গী থাকবেই। চার বছর আগে দিল্লিতে ছিল, একবার গ্রেফতার হয়, কিন্তু প্রিজন ভ্যান থেকে পালিয়ে যায়। সবসময়ে ঘুরে বেড়ায়, কোথাও থেমে থাকে না। প্রপার আইডেন্টিফিকেশনের জন্য দিল্লি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সঙ্গে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
সকাল আটটায় টেলেক্স করল অজিত। কী হবে কে জানে!
তারপর ফোন করল ভজনা দেবীকে, মাতাজি, পীতাম্বর সাহেবের সত্যিই ফাঁড়া।
ভজনা দেবী শান্ত গলাতেই বলেন, কী হয়েছে রে?
আপনি অনেক ভি আই পিকে চেনেন মাতাজি। আপনি বললে তাড়াতাড়ি কাজ হবে। মিশিরজি বিপন্ন। নিজের বাড়িতেই উনি একজন উগ্রবাদীর প্রতিভূ হয়ে আছেন।
কী যা-তা বলছিস রে পাগলা?
ঠিকই বলছি।অজিত সংক্ষেপে ঘটনাটা বলে গেল।
ভজনা দেবী একটু চুপ করে থেকে বলেন, তোকে তো বলেইছি ওর ফাঁড়া আছে।
এখন জ্যোতিষ ছাড়ুন মাতাজি। মবিলাইজ অল রিসোর্সেস।
আমার কি সত্যিই কিছু করা উচিত?
সেটা আপনার ধর্মই আপনাকে বলে দেবে। তিনি তো আপনার হাজব্যান্ড। ডিভোর্স পীতাম্বর করলেও আপনি তো মানেননি মাতাজি। আপনি সিঁদুর পরেন।
তুই তো আমাকে মা ডাকিস। এখন মাতাজি ডাকছিস কেন?
উঃ মা, এখন এই বিপদের মধ্যে ওসব প্রশ্ন কেন?
ভজনা দেবী আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেন, কেন যে তুই আবার আমাকে ওর ব্যাপারে জড়াতে চাইছিস!হা রে, তোর কোনও ভুল হচ্ছে না তো! লোকটা হয়তো সত্যিই ওর শ্বশুরবাড়ির লোক।
না মা, আমি তোক চিনি৷ এ হচ্ছে, সুরেন্দ্র বা সুরিন্দর। ব্যাড নেম ইন পুলিশ রেকর্ড।
তুই একটা কাজ করবি অজিত?
কী কাজ?
আর-একবার ওখানে যা।
গিয়ে?
ভাল করে বুঝে আয়। নইলে একটা হাল্লা মাচিয়ে পরে লজ্জায় পড়ে যেতে হতে পারে।
ঠিক আছে মা, যাব। কিন্তু আপনি ইতিমধ্যে বসে থাকবেন না কিন্তু। কিছু হয়ে যেতে পারে।
তুই আগে যা তো! কিন্তু খুব সাবধান।
অজিত গিয়েছিল। আর গিয়েছিল বলেই স্কুপ খবরটা দিতে পেরেছিল একমাত্র নিউ পাটনা টাইমস। পীতাম্বর, তার যুবতী বউ, দু’জন কাজের লোক অটোমেটিক রাইফেলের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে ছিল বিশাল বাড়ির বিভিন্ন জায়গায়। পীতাম্বরের লাশ পড়ে ছিল তার প্রিয় নিমগাছের ছায়ায়। তার সত্তর বছরের মজবুত শরীর— যা নিয়ে চাপা অহংকারও ছিল তার প্রায় দু’ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল কোমরের কাছ বরাবর। নিউ পাটনা টাইমস-এর সব কপি বিক্রি হয়ে গেল চোখের পলকে। ঝোড়ো কাকের মতো চেহারায় অজিত যখন পাটনায় ফিরে অফিসে এল তখন রঙ্গনাথ তার পিঠ চাপড়ে একশো টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিলেন।
অজিত ভ্রুক্ষেপও করল না। টেলেক্সে আর-একটা মেসেজ পাঠাল দিল্লিতে। তিনজন উগ্রবাদী পীতাম্বরকে সপরিবারে খতম করে রাত বারোটার ডাউন দানাপুর এক্সপ্রেস ধরেছে। লোকাল পুলিশ খবর নিয়েছে, তাদের কলকাতার টিকিট ছিল।