সেরকমই ভাবলেন। কিন্তু আমাকে পাঠিয়েছিলেন রঙ্গনাথজি। পীতাম্বরের লেখা তো খুব ঝাল মশলাদার হয়, ইংরিজিটা লেখেনও চোস্ত। কাগজটা একটু হয়তো চলবে।
বউটা কি ভাল? যত্নআত্তি করে?
সেটা কী করে বলব? তবে মিশিরজি ভালই আছেন।
লালুয়াটা কেমন আছে?
ভাল মা। সব ভাল।
ভাল হলেই ভাল। তবে একটা ফাঁড়া আছে মিশ্ৰজির।
এর বেশি কিছু আর ভজনা দেবী বলেননি। অজিতেরও আগ্রহ হয়নি জানবার।
পুজোর আগে রঙ্গনাথজি ডেকে বললেন, অজিত, পীতাম্বরের কোনও খবর নেই। লেখাটা কী হল? তুমি পাত্তা লাগাও।
ঠিক আছে, চিঠি দিচ্ছি।
আরে দূর। পীতাম্বর চিঠির জবাব দেওয়ার মতো ভদ্রলোক নাকি? নিজে চলে যাও। ক্যাশ থেকে যাওয়া-আসার ভাড়া তুলে নিয়ে যাও, আমি অ্যাকাউনট্যান্টকে স্লিপ পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ফের পীতাম্বরকে ধরা-করা করতে এল অজিত। এসেই বুঝল, সব ঠিকঠাক নেই। কোথায় একটা ছন্দপতন ঘটেছে। সেটা এতই বেশি যে, ফটকে ঢোকবার আগেই বোঝ যায়। ফটকের কাছে লালুয়া দাঁড়িয়ে ছিল, অজিতকে দেখেই হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে দৌড়ে ভিতরে চলে গেল। অজিত কাছে এসে দেখল, ফটকে তালা আটকানো। দুটোই অস্বাভাবিক ঘটনা।
অজিত বাইরে থেকে চেঁচিয়ে ডাকল, লালুয়া! এ লালুয়া! মহেন্দর!
একটু বাদে লালুয়া বেরিয়ে এল। হাতে চাবি। মুখে হাসি নেই। ফটক খুলে অজিতকে ঢুকতে দিয়েই আবার তালা আটকাল।
অজিত অবাক হয়ে বলে, তালা দিচ্ছিস কেন?
ওইসাহি হুকুম হ্যায়।
বাইরে নিমগাছের ছায়ায় তাকে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল লালুয়া। বাইরে যে খুব কিছু পরিবর্তন হয়েছে তা নয়, কিন্তু অজিত কেমন অস্বস্তির সঙ্গে অনুভব করল, বাড়িটায় কোনও প্রাণ নেই। কেন যেন থমথম করছে।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে পীতাম্বর এলেন। অপেক্ষাকৃত ধীর চলন। মুখ একটু যেন বেশি গম্ভীর। কিংবা গাম্ভীর্যের চেয়ে বলা উচিত উদ্বিগ্ন। গ্রীষ্মকালে যা দেখে গিয়েছিল তার চেয়ে যেন এই কয়েক মাসে একটু বুড়িয়ে গেছেন।
মিশিরজি, কী হয়েছে?
কিছু হয়নি তো! কী হবে?–পালটা বিস্ময় প্রকাশ করেন পীতাম্বর। কিন্তু সেটা বিশ্বাসযোগ্য হল না। কৃত্রিম শোনাল।
আপনার শরীর খারাপ করেনি তো?
শরীর থাকলেই খারাপ-ভাল হয়।–শুকনো গলায় বললেন পীতাম্বর। আত্মবিশ্বাসের অভাব রয়েছে গলায়।
কে জানে বাবা কী। নতুন বউটা পালিয়ে-টালিয়ে যায়নি তো! বিয়েটাই বোধহয় ভুল হয়েছিল। অজিত বিনীতভাবে লেখাটার কথা তুলতেই পীতাম্বর যেন চমকে ওঠেন, লেখা! কীসের লেখা!
ভুলে গেছেন মিশিরজি? আমাদের কাগজে লিখবেন বলেছিলেন যে। রঙ্গনাথজির সঙ্গে কথা হয়ে গেছে। লেখা না পেলে আমার চাকরি থাকবে না।
পীতাম্বরের মুখে বিরক্তি এবং হতাশা যুগপৎ ফুটে উঠল। তেতো গলায় বললেন, লেখা টেখা আমার আসছে না বাপু। আমি খুব পরেসান আছি।
কেন মিশিরজি?
এত প্রশ্ন করো কেন অজিত? আমি এত প্রশ্নের জবাব দিতে পারব না।
রাগলে পীতাম্বর একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন বটে, কিন্তু সহজে রাগবার পাত্রই উনি নন। সারাজীবন পলিটিক্স করে করে ঝানু হয়েছেন। গালমন্দ অপমান বিস্তর হজম করতে হয়েছে। রাগ উত্তেজনা ভাবাবেগ সবই অতিশয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন। তাই এই সামান্য কথায় পীতাম্বরকে রেগে যেতে দেখে অজিত খুবই অবাক হল। এরপর কী বললে পীতাম্বর রাগ করবেন না সেটা বুঝতে না পেরে অজিত চুপচাপ বসে থাকে কিছুক্ষণ। হতবুদ্ধি।
পীতাম্বর নিজে থেকেই বললেন, আজ বরং যাও অজিত। পরে যোগাযোগ কোরো। আমার এখন একটু–
বলেই থেমে গেলেন।
অজিত খুব গাড়ল নয়। সাংবাদিকতা করে করে তার চোখ কিছু পেকেছে। হঠাৎ তার মনে হল, মুখ নয়, কিন্তু পীতাম্বরের চোখ তাকে কিছু বলতে চাইছে। সে স্থির চোখে পীতাম্বরকে নজর করতে করতে বলল, মিশিরজি, আমি আপনার অতিথি। অন্তত একটু জলও তো পেতে পারি।
জল! ওঃ হ্যাঁ। নিশ্চয়ই। এ লালুয়া
লালুয়া নয়, খুব ধীর পায়ে পায়জামা আর গেঞ্জি পরা একটা বিশাল চেহারার যুবক সামনের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পেয়ারা গাছটার নিচু ডালে হাতের ভর রেখে দাঁড়াল। ছোকরাকে জন্মে দেখেনি অজিত।
লোকটি কে মিশিরজি?
পীতাম্বর খুব দ্রুত বললেন, আত্মীয় হয়। আমার শ্বশুরবাড়ির দিকের।
পীতাম্বর জীবনে মিথ্যে কথা বলেছেন খুবই কম। হয়তো-বা একটিও বলেননি। এই মিথ্যেটা বলতে তাই বোধহয় তার মুখ ব্যথাতুর হয়ে উঠল। আগন্তুকটি কদাচ মিঠিয়ার আত্মীয় হতে পারে না। মিঠিয়া দেহাতি পেঁয়ো যুবতী, এ ছোকরার চোখে মুখে শিক্ষা ও আভিজাত্যের ছাপ আছে।
হঠাৎ পীতাম্বর বলে উঠলেন, যা দেখতে পাচ্ছ না তা কল্পনা করে নিয়ো না অজিত। প্লিজ।
কথাটার মানে অজিত বুঝতে পারল না। আলটপকা এ কথাটা পীতাম্বর বলছেন কেন? তবে সে ফের স্পষ্টভাবে টের পেল, পীতাম্বরের মুখ এক কথা বলছে, কিন্তু চোখ অন্য কিছু বলতে চাইছে।
অজিত খুব ভিতু নয়। সে মাফিয়া লিডার থেকে শুরু করে খুনে লুচ্চা বদমাশ বিস্তর ঘেঁটেছে চাকরির সুবাদে। সে হঠাৎ খুব বিনয়ের সঙ্গে বলে, ছোটে মাতাজির আত্মীয়ের সঙ্গে কি পরিচয় হতে পারে না মিশিরজি?
পীতাম্বর হঠাৎ সচকিত হলেন, পরিচয়! ওঃ হ্যাঁ, কেন নয়?
পীতাম্বরের অস্বস্তি লক্ষ করে হঠাৎ অজিত লোকটার দিকে চেয়ে একটু হেসে বলে, নমস্তে জি, আইয়ে না, বৈঠিয়ে ইহা পর।