ভ্রু কুঁচকে পীতাম্বর বলে, জানি। ভজনার কাছে এখন বহু ভি আই পি তাদের ভাগ্য জানতে আসে। অনেকে নাকি তাকে আজকাল মাতাজি বলেও ডাকে। খুব শিগগিরই হয়তো সে একটা স্পিরিচুয়াল লিডার হয়ে উঠবে। এই পোড়া দেশে এরকম ঘটাই তো স্বাভাবিক। তুমি বোধহয় তার কাছে যাতায়াত করো!
মিশিরজি, উনি আমাকে স্নেহ করেন। আমাদের কাগজে ওঁকে লিখতে রাজি করিয়েছিলাম আমি। যতদিন উনি লিখবেন ততদিন আমি সেফ।
পীতাম্বর হঠাৎ হাঃ হাঃ করে হাসলেন, তাই বলো! ভজনাকে তা হলে তুমিই ভিড়িয়েছ ওই কাগজে। এখন আমার কাছে আসার মতলবটা কী? ভজনা যখন তোমার ফেবারে আছে তখন চিন্তা কীসের?
কাগজটা রিভাইটালাইজ করতে হলে আপনাকেও আমাদের দরকার। আপনি একসময়ে দারুণ জার্নালিজম করেছেন।
লেখা-টেখা আমি ছেড়ে দিয়েছি অজিত। লিখে কিছু লাভ নেই। যে দেশে নিরক্ষরের হার এত বেশি সে দেশে কাগজে লিখে কোনও ফল হয় না। আমি যা বলতে চাই তা ওই নিরক্ষরদের জন্যই। আমি অন্য মিডিয়ামের কথা ভাবছি যা কোটি কোটি মানুষের কাছে পৌঁছবে।
মিশিরজি, সমস্যাটা আমার একার নয়। গোটা কাগজ এবং তার চল্লিশ-পঞ্চাশজন কর্মচারীর। আপনি লিখতে শুরু করলে কাগজটা বোধহয় বেঁচে যাবে।
কমপ্লিমেন্ট দিচ্ছ। একে যে তেল-দেওয়া বলে তা জানো?
জানি। আর এও জানি যে মানুষ সত্তর বছর বয়সে এ কে ফর্টি সেভেন নাড়াচাড়া করে সে তেলের তোয়াক্কা করে না।
পীতাম্বর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলেন, আমি যা লিখব তা ছাপাতে পারবে?
অজিত একটা গভীর শ্বাস ফেলে বলে, আপনি এখন উগ্রবাদ নিয়েই বোধহয় লিখবেন? তা-ই লিখবেন। ছাপব।
ইট মে বি ভেরি এক্সপ্লোসিভ অ্যান্ড ডেনজারাস অ্যান্ড সিডিশাস। রঙ্গনাথ অ্যারেস্টও হয়ে যেতে পারে।
রঙ্গনাথজির অনেক দোষ আছে, কিন্তু উনি এ ব্যাপারে খুব সাহসী। উনি আগেও দু’বার গ্রেফতার হয়েছেন এবং আমাদের কাগজের বিরুদ্ধে অন্তত চারটে ডিফারমেশন কেস ঝুলছে।
লেখা কিন্তু এডিট করতে পারবে না।
পাগল! আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?
ঠিক আছে, তোমার মুখ চেয়ে লিখব। তুমি আমার ছেলের মতো। তোমার অনেক কিছুই আমার পছন্দ নয়, তবু স্নেহ জিনিসটা বোধহয় কোনও যুক্তিরই ধার ধারে না। আচ্ছা একটা কথা বলতে পারো, বাঙালিদের এরকম হাল হল কেন?
কীরকম হাল মিশিরজি?
কিছুদিন আগে পুরুলিয়ায় দুটো শিখ উগ্রবাদী ঢুকে পড়েছিল, মনে আছে?
আছে।
সংখ্যায় তারা মাত্রই দু’জন। দুটো নোক সারা জেলায় দাপাদাপি করে বেড়াল, মানুষ মারল, পুলিশ মারল। তাদের ভয়ে প্যান্টে পেচ্ছাপ করে দেওয়ার মতো অবস্থা হল পুলিশের। ধেয়ে এল লালবাজার এবং বিরাট অপারেশনের আয়োজন হল। প্রায় বাঘ মারার মতো করে মারা হল তাদের। হোয়াট এ গ্রেট ফুলিশনেস। যেখানে দু’জন উগ্রপন্থীকে ধরলে অনেক ইনফর্মেশন আদায় করা যেত, পাওয়া যেত অনেক গুপ্ত খবর সেখানে তাদের ধরার চেষ্টাই হল না। মেরে ফেলা হল। অথচ সে দুটো মানুষ তখন অবসন্ন, ক্লান্ত, বিধ্বস্ত। লড়াই করার ক্ষমতাও তাদের আর ছিল না। আর কিছুক্ষণ ঘিরে রাখলেই অজ্ঞান অবস্থায় তাদের ধরা যেত। কিন্তু বাঙালি পুলিশ এত ভয় খেয়ে গিয়েছিল যে, তারা সেই চেষ্টাই করেনি। আমি শুধু ভাবছি মাত্র দুটো লোক আর দুটো এ কে ফর্টি সেভেন যদি তোমাদের এই অবস্থা করতে পারে তা হলে পঞ্চাশ বা পাঁচশো উগ্রবাদী ঢুকে পড়লে তো তোমাদের সরকার গদি ছেড়ে পালিয়ে যাবে! বাঙালিদের হল কী অজিত? উগ্রবাদের আগরওয়ালাদের এই হাল কেন?
মিশিরজি, আপনি বড় উগ্রবাদের ভক্ত হয়ে পড়েছেন।
না রে বাচ্চা, আমি আরও বেশি ভক্ত হয়ে পড়েছি এ কে ফর্টি সেভেনের। আমি রোজ অস্ত্রটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। চিনের সবচেয়ে সাকসেসফুল এক্সপোর্ট আইটেম। তার চেয়েও বড় কথা, এ কে ফটি সেভেনই এখন ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় সম্মানিত জিনিস।
অস্ত্রটা আপনাকে কে দিল?
আছে আছে। তুমিও যদি চাও তো পাবে। কিছু টাকা খরচ করতে হবে, এই যা। নিমগাছের নীচে গিয়ে বসো, আমি মিঠিয়াকে ডাকছি। সে বোধহয় গোসলখানায় আছে।
আমার দ্বিতীয় পক্ষকে দেখে যাও, ভজনাকে গিয়ে বোলো কেমন দেখলে।
লজ্জা পেয়ে অজিত বলে, কী যে বলেন মিশিরজি!
নিমের ছায়ায় বসে লালুয়ার এনে-দেওয়া এক গেলাস ঘোল খেল অজিত। তারপর মিশিরজি এলেন, পিছনে সদ্যস্নাতা এক যুবতী। যুবতীই বটে। সারা অঙ্গে এমন উচ্চাবচ ব্যাপার যে তাকাতে লজ্জা করে।
আরে আরে, নববধুর মতো মুখ নামিয়ে নিলে যে! দেখো, ভাল করে দেখে নাও। ভজনাকে গিয়ে বোলো, আমার বয়স সত্তর আর আমার দ্বিতীয় পক্ষের বয়স তেইশ, তবু ওর কোনও অভিযোগ নেই। শি ইজ কনটেন্টেড। ইচ্ছে করলে তুমি ওকেও জিজ্ঞেস করে দেখতে পারো। তবে খবরদার, পরকীয়া করার চেষ্টা কোরো না। জানোই তো, আমার এ কে ফর্টি সেভেন আছে।
এটা সেই গ্রীষ্মকালের কথা। অজিত পাটনায় ফিরে পরদিনই ভজনা দেবীর বাড়িতে গেল। ভজনাকে সে মা বলে ডাকে। শুধু জ্যোতিষী করে কেউ যে এই ভাল আর্থিক অবস্থায় পৌঁছতে পারে তার ধারণা ছিল না অজিতের। আগেও জ্যোতিষবিদ্যা চর্চা করতেন, ডিভোর্সের পর সেটা পেশা হিসেবে নিলেন। পাটনার এক গলিতে একখানা ঘর নিয়ে থাকতেন। এখন বাড়ি করেছেন দোতলা। গাড়িও কিনবেন। পীতাম্বর মিথ্যে বলেননি, অনেকেই আজকাল ভজনাকে মাতাজি বলে ডাকে। তার চেয়েও বড় কথা ভজনা দেবী এখন এক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব, নানা পর্যায়ে তার প্রভাব ক্রমে বাড়ছে। বেশিরভাগ সময়েই লালপেড়ে গরদ পরে থাকেন, সিঁথিতে তেল সিঁদুর বহাল আছে। অজিতের কাছ থেকে বিবরণ শুনে বললেন, মিশিরজির কাছে তুই হঠাৎ যেতে গেলি কেন? লোকটা ভেবে নিল, আমিই তোকে পাঠিয়েছি ওর নতুন বউকে দেখে আসতে।