শ্যামল খুব ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে বলে, তুমি নামতে চাও? কিন্তু ট্রেন হঠাৎ ছেড়ে দিলে!
মোটেই নামতে চাই না। তুমিও নামবে না। সকাল থেকে মেয়েটাকে আগলে বসে আছি। ওকে একটু রাখো, আমি শোব। মাথা ধরেছে।
অগত্যা মেয়েকে কোলে নিয়ে শ্যামল বলে, একটু দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াতে পারি কি? না কি তাতেও আপত্তি আছে?
গাড়ি থেকে নামবে না কিন্তু, খবরদার!
আরে না।
করিডোরে এখন দু’দিকেরই দরজা খোলা। চারদিকে খাঁ খাঁ করছে রোদ। প্রকৃতির দৃশ্য এখন আর তত সুন্দর নেই। রুক্ষ, গরম, ঘোলাটে, বাইরে অন্তত কয়েকশো লোক নেমে দাঁড়িয়ে বা বসে আছে। হকার ঘুরছে। শান্ত মেয়েটিকে কোলে নিয়ে শ্যামল দাঁড়িয়ে রইল। থেমে থাকা ট্রেনের মতো এমন অভিশাপ আর মানুষের জীবনে কীই বা আছে?
ওটা কী বাবা?
শ্যামল হঠাৎ দুর্দশার কথা ভুলে মেয়ের গালে নাক ডুবিয়ে দিল।
০৩. মস্ত নিমগাছের ছায়ায়
॥ তিন ॥
মস্ত নিমগাছের ছায়ায় এখনও খাঁটিয়া পাতা। খাঁটিয়ায় আধময়লা সবুজ সস্তা একখানা চাদর বিছানো, একখানা বালিশ। খাঁটিয়ার মাথার দিকে পায়ার কাছে ঝকমকে পেতলের ঘটি, তাতে ঢাকনা দেওয়া। পীতাম্বর মিশ্র সুতরাং বাড়িতেই আছেন। রিকশা থেকে নেমে কাঠের ফটক ঠেলে বাড়ির চত্বরে ঢুকেই অনুমানটা মজবুত হল অজিতের। পীতাম্বর মিশ্রের দৃঢ় বিশ্বাস নিমগাছের ছায়া এবং নিমের হাওয়ার জোরেই সত্তরেও তার স্বাস্থ্য এত ভাল।
স্বাস্থ্য কতটা ভাল এবং সক্ষম সেটা পরীক্ষা করতেই কি পীতাম্বর হঠাৎ মাত্র কয়েকমাস আগে ছাব্বিশ বছরের দুরন্ত এক দেহাতি যুবতীকে বিয়ে করে বসলেন? না কি বিয়েটা আসলে এতদিন বাদে তার “এক্স ওয়াইফ” ভজনাদেবীর ওপর প্রতিশোধ নিতেই?
বেলা সাড়ে দশটাও বাজেনি, গরমের রোদে চারদিক যেন চিতাবাঘের মতো ওত পেতে আছে। বিহারের গ্রীষ্ম মানেই বাঘের থাবা। পীতাম্বর মিশ্রর বাড়িটা তেমন কিছু দেখনসই না হলেও এলাকা বিশাল। চারদিক মাটি আর ইটে গাঁথা উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ডানদিকে মস্ত ইদারা দেখা যাচ্ছে। ইদারার ওপর কপিকল লাগানো। সরু শেকলে বাঁধা বালতিতে মহেন্দ্র জল তুলছে।
অজিত একটু দুর থেকেই হাঁক দিল, মহিন্দর, মিশিরজি হ্যায়?
জি সাব। বৈঠ যাইয়ে। লালুয়া, আরে এ লালুয়া, চারপাই লাগা রে!
পীতাম্বর মিশ্রর পার্সোনালিটিকে কখনও সন্দেহ হয়নি অজিতের। তার ঘরদোর এবং তাকেও যারা সামলে রাখে তারা কেবলমাত্র বেতনভুক চাকরবাকর নয়। এরা মিশ্রজির ভক্ত এবং অনুগামীও বটে। মহেন্দ্ৰ বোধহয় ত্রিশ বছরের ওপর পীতাম্বরের কাছে আছে। লালুয়াও আছে শিশুকাল থেকে। পীতাম্বরের কাছ থেকে এরা অর্থকরী দিক দিয়ে তেমন কিছু পায় না, অজিত জানে।
অনাথ শিশু লালুয়া এখন কিশোরটি হয়েছে। থ্যাবড়া নাকের নীচে গোঁফের সুস্পষ্ট আভাস, পুরু ঠোঁটের ফাঁকে তৃপ্তি এবং আনন্দময় একটা হাসি। চারপাইটা ছায়ায় পেতে দিয়ে খুশিয়াল গলায় বলে, বৈঠ যাইয়ে। অউর বিড়ি মত পিজিয়ে।
এ বাড়ির চৌহদ্দিতে ধূমপান নিষেধ। খৈনিও নয়। এ বাড়িতে চা বা অন্য কোনও নেশার দ্রব্যের প্রচলন নেই। পীতাম্বর নেশার ঘোর বিরোধী। অজিত দড়ির চারপাইতে বসে বলল, পানি তো পিলা রে।
পানি এবং পীতাম্বর প্রায় একসঙ্গেই এলেন। পরনে ধুতি, গায়ে একটা ফতুয়া গোছের জিনিস, তাতে পকেট আছে। পায়ে খড়ম। গামছাও থাকে কাঁধে, তবে এখন সেটা বালিশের আড়ালে রাখা আছে, দেখতে পেল অজিত। গত বাইশ বছরে পীতাম্বর তেমন পালটায়নি। বাইশ বছর ধরে অজিত তাকে দেখে আসছে। তারও আগে থেকেই পীতাম্বর বোধহয় একইরকম থেকে গেছেন।
পীতাম্বর প্রেসিডেন্সিতে পড়েছেন, কলকাতায় ছাত্র আন্দোলন করেছেন এবং কিছুদিন চাকরিও। জলের মতো বাংলা বলতে পারেন। অজিত যেমন পারে হিন্দি বলতে। কিন্তু পীতাম্বর বোধহয় অজিতের হিন্দিকে তেমন বিশ্বাস করেন না, বরাবর অজিতের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন। অজিত যখন জল খাচ্ছিল তখন পীতাম্বর খাঁটিয়ায় বসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকে দেখছিলেন।
আশাকরি তুমি ইন্টারভিউ নিতে আসোনি!
অজিত একটু অবাক হয়ে বলে, ইন্টারভিউ? না তো!
মজবুত দাত দেখিয়ে পীতাম্বর হাসলেন, আমি এখন নিঃশেষিত পানপাত্র। কেউ আর পোঁছে না। তবে বিয়ে করার পর কিছু কাগজ কেচ্ছা হিসেবে সেটা ছেপেছে। তোমার মতলব কী? ইজ ইট এ প্রফেশনাল ভিজিট?
অজিত পিতাম্বরকে ভালই চেনে। যখন রাজনীতি করতেন তখনও রাজ্যসভায় মাঝে মাঝে এমন সব অদ্ভুত মন্তব্য করতেন বা ছড়া কাটতেন যে লোকে বলত ছিটিয়াল।
তোমার স্বাস্থ্য ভাল হয়নি। তোমার চোখ দেখে মনে হয় লিভার ভাল কাজ করছে না। বোধহয় রাত জাগো। আজকাল কি ড্রিংকও ধরেছ নাকি?
না মিশিরজি। আপনি তো জানেন নিউ পাটনা টাইমস ছোট কাগজ। ভাল চলছে না। রিট্রেনচমেন্ট তো হবেই, কাগজও উঠে যেতে পারে। আমি খুব দুশ্চিন্তায় আছি।
তোমার এডিটর রঙ্গনাথ হচ্ছে একটি আস্ত পাঠা, বিক্রি বাড়াতে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিংয়ের নামে বদনাম ছড়াচ্ছে। ওতে কি কাগজ চলে? এ দেশে খবরের অভাব নেই, ঠিকমতো লিখতে পারলে কত খবর কুড়িয়ে আনা যায়। তোমরা শুধু বস্তাপচা রাজনীতি ছাপবে, তাতে হয়? এ দেশের রাজনীতি নিয়ে কারও কোনও মোহ আছে বলে মনে করো? আমি তো করি না। আমি কীসের ওপর রিসার্চ করছি এখন জানো?