বেশ করেছি। যা ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছিল! সেইজন্যই তো উঠে মাসিমার কাছে গিয়েছিলাম।
তাকাচ্ছিল! ওয়েল, ওয়েল, দ্যাটস এ গুড সাইন।
তোমার মুন্ডু! এখন যাও তো, ওপরে ওঠো। পর্দাটা টেনে দাও।
পায়জামা আর হাওয়াই শার্ট পরা একটা লোক এসে কিউবিকলের ভিতরে উঁকি দিয়ে বলে, ঠান্ডা কমিয়ে দিয়েছি স্যার। বুঝতে পারছেন?
বকুল বলে, না তো। বেশ ঠান্ডাই লাগছে।
আর দশ মিনিটের মধ্যেই টের পাবেন। না হলে বলবেন আমাকে, আমি মেশিনের। কাছেই থাকব।
ঠান্ডাটা বাস্তবিকই একটু কম-কম লাগছিল শ্যামলের। একটু লজ্জাও করছিল। সে পারেনি। বিশ্বরূপ পারল।
ছেলেটা ফিরে আসতেই শ্যামল বলে, থ্যাংক ইউ। আমি লোকটাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মেঝেয় পড়ে ঘুমোচ্ছিল, তাই বুঝতে পারেননি।
বকুল একটু কৃতজ্ঞতার হাসি হেসে বলে, আপনাকে উঠতে হল, লজ্জা করছে সেজন্য। আসলে আমার কর্তাটি একদম মুখচোরা মানুষ। আমিই ওকে চালিয়ে নিই।
বুঝতে পারছি। আপনাদের আরও একটা প্রবলেম আছে বোধহয়। হাওড়া স্টেশনে বেশি রাতে পৌঁছানোর প্রবলেম।
শ্যামল সোৎসাহে বলে, হ্যাঁ, বিগ প্রবলেম।
বিশ্বরূপ মৃদু হেসে বলে, নো প্রবলেম। আমার জন্যও স্টেশনে একটা গাড়ি থাকবে। সেই গাড়িই পৌঁছে দেবে আপনাদের। নিশ্চিন্তে ঘুমোন।
ভগবানে বিশ্বাস ছিল না শ্যামলের। এখন মনে হল, বলা যায় না, ওরকম একটা কেউ থাকলেও থাকতে পারে। একটু একচোখো বটে, বড়লোকদের পিছনেই বেশি তেল খরচা করে বটে, কিন্তু মাঝে মাঝে ঘোর নাস্তিককেও একটু খাতির-টাতির দেখায়।
বারকয়েক থ্যাংক ইউ বলে বাঙ্কে উঠে পড়ল শ্যামল। এত নিশ্চিন্ত এত ভারহীন লাগছিল তার যে ঘুম আসতে চাইছে না। অথচ, কামরায় গাড়িভরা ঘুম, রজনী নিঝুম। বাস্তবিকই নিঝুম। হঠাৎ একটু সচকিত হয়ে ওঠে সে, গাড়িটা কি বড্ড বেশি জোরে চলছে না! বড্ড বেশি দুলছে না! ব্রেক-ট্রেক ফেল করেনি তো! এমনও তো হতে পারে যে, কয়েকজন সন্ত্রাসবাদী ইঞ্জিনে উঠে অ্যাট গান-পয়েন্ট ড্রাইভারকে বাধ্য করছে গাড়ি একনাগাড়ে চালিয়ে নিতে। এ দেশে সবই হতে পারে। কিছু বিশ্বাস নেই।
বাথরুম ঘুরে আসবে বলে বাঙ্ক থেকে নেমে সে দেখল, বকুল আর টুকুস নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। ওপরের বাঙ্কে মাড়োয়ারি, নীচের সিটে বিশ্বরূপ এবং আশেপাশে কেউ জেগে নেই। সে করিডোরে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট খেল। ট্যাপ থেকে একটু জলও খেল।
এরপর ঘুমটা হল তার। লম্বা ঘুম। সকাল আটটা পর্যন্ত। তখনও পাটনা জংশন আসেনি। আসতে দেরি আছে। টুকুস শান্তভাবে বসে বিস্কুট খাচ্ছে। বকুল আধো-জাগা আধো-ঘুমে শুয়ে আছে তখনও। বিশ্বরূপ জানালার বাইরে তেমনি চেয়ে আছে। মাড়োয়ারি ভদ্রলোক বোধহয় বাথরুমে।
শ্যামল ঘড়ি দেখে বলল, আরও লেট করেছে নাকি ট্রেন?
বিশ্বরূপ মুখ ফিরিয়ে একটু হাসল, করেছে। কিন্তু দারুণ রান করছিল মাঝরাতে। মোঘলসরাইয়ের আগে আটকে ছিল অনেকক্ষণ।
এঃ, তা হলে যা ভয় করছিলাম তাই হল।
কীসের ভয়?
মধ্যরাত্রির ভয়।
বিনা স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে গেল। কামরার আবছায়া থেকে করিডোরে বেরিয়ে আসে শ্যামল। হাতে পেস্ট লাগানো টুথব্রাশ, কঁাধে তোয়ালে। ডানদিকের দরজাটা খোলা। দরজার সামনে উবু হয়ে বসে একটা লোক দাতন করছে। আর দরজার ওপাশে হা হা করছে উদোম চাষের মাঠ, রোদে ঝলমল। ঠান্ডা বাতাস আসছে হু হু করে। কী যে অপার্থিব সুন্দর লাগল এই পৃথিবীকে! মুগ্ধ হয়ে শ্যামল চেয়ে থাকে। গাছপালা, খেতখামার, কুটির, বোদ, দিগন্ত সে কি অনেক দেখেনি? তবু মাঝে মাঝে এরা সব এক বিশেষ বিন্যাসে এমন অপরূপ হয়ে যায়, যেন ম্যাজিক। আসলে তার মনটাও বোধহয় আজ ভাল আছে। কোনও টেনশন নেই। কিছুক্ষণের সম্মোহন কাটিয়ে সে বাথরুমে ঢুকে গেল।
সম্মোহন আরও কাটল যখন বেলা তিনটে নাগাদ ঝাঝা স্টেশনের আগে গাড়ি একদম চুপ মেরে গেল। গেল তো গেলই। নট নড়নচড়ন নট কিচ্ছু। এক ঘণ্টা বাদে অফ করে দেওয়া হল এয়ার-কন্ডিশনার। শোনা গেল, সামনের লাইনে ফাটল। ট্রেন কখন ছাড়বে ঠিক নেই। কন্ডাকটর আর মেকানিকের সঙ্গে কিছু যাত্রী লড়ালড়ি করল বটে, কিন্তু কন্ডাকটর সাফ জবাব দিল, ট্রেন চালু না হলে এ সি চালানো যাবে না সাহেব। মেশিন বসে যাবে। সুতরাং বদ্ধ কামরা গরম হতে লাগল। ভেপে উঠতে লাগল।
বকুল বলল, কী হবে?
হতাশ শ্যামল বলে, কী আর হবে! সাফার করা ছাড়া আর কী উপায় আছে?
কামরার গরম ভ্যাপসা ভাব সহ্য করতে না পেরে অনেকেই ট্রেন থেকে নেমে দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। বিশ্বরূপ অনেকক্ষণ হল সিটে নেই। মাড়োয়ারিও নেই। শ্যামলও উঠল।
কোথায় যাচ্ছ? সিগারেট খেতে?
আরে না। সিগারেটও শেষ হয়ে এল প্রায়। আর মোটে গোটা পাঁচেক আছে। আদ্রা বা পাটনায় কিনে নিলে হত। বাইরে গিয়ে একটু ভোলা হাওয়ায় দাঁড়াই।
আচ্ছা স্বার্থপর তোক তো তুমি! নিজে গিয়ে খোলা হাওয়ায় দাঁড়াবে! আর আমরা।
এইভাবেই সূচনা হয় এবং লেগে যায়। বিবাহিত জীবনকে কি এখন ভয় পায় শ্যামল? পায় বোধহয়। আবার বকুল ছাড়াও কি তার চলে? প্লাসও আছে, মাইনাসও আছে। পাঁচ বছর বয়সি বিয়েটা শেষ অবধি টিকে থাকবে কি না এ নিয়েও তার সন্দেহ আছে। মাঝে মাঝে এমন পর্যায়ে চলে যায় তাদের ঝগড়া যে শ্যামল সংসার-ত্যাগের কথা ভাবে, ডিভোর্সের কথা ভাবে। মেয়েটা হওয়ার পর থেকে সম্পর্কের কিছু অবনতি হয়েছিল। তারপর থেকে ক্রমাবনতি।