জানে না, আবার জানেও। কুয়াশামাখা সেই সমুদ্রগামী বিস্তীর্ণ নদীর মধ্যেই ছিল সেই অলৌকিক। তার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। সেই ডাকই শুনে থাকবে নিশি-পাওয়া অলক।
ক্ষয়া এক চাঁদ অলক্ষে অস্তাচল থেকে নামিয়ে দিয়েছিল তার আলোর কিছু জাদু। সেই আলোয় কুয়াশায় ঘনীভূত হয়ে উঠল জল থেকে এক অপরূপ উত্থান। অলক তখন লঞ্চ থেকে অনেক দুরে, নিরুদ্দেশ যাত্রায় ভেসে যাচ্ছে আয়াসহীন। হঠাৎ দেখল অদূরে জলের ওপর সোনালি নীল রুপালি গোলাপি মাখানো এক অপরূপ জলকন্যা। আনমনে ভেসে আছে জলের ওপর। চোখ সুদূরে। এলো সোনারঙের চুল উড়ছে হাওয়ায়।
কয়েক পলক মাত্র। তারপরেই কুয়াশা এসে ঢেকে দিল তাকে। চাঁদ ড়ুবল।
জলের ওপর স্রোতের বিরুদ্ধে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে ভেসে থাকল অলক। এইজন্যই ভূতগ্রস্তের মতো তার এতদূর আসা? কে ডাকল তাকে? কেন?
খুব ক্লান্ত হাতে-পায়ে উজান ঠেলে যখন সে লঞ্চে এসে উঠল তখনও সকলেই ঘুমে। গা মুছে, শুকনো কাপড় পরে আবার কম্বলের তলায় গিয়ে ঢুকল অলক। কিন্তু ঘুম হল না। সারা দিনটাই কেটে গেল আনমনে।
সেই শুরু। কিন্তু শেষ নয়। মাঝে-মধ্যে তাকে দেখেছে অলক। ভোরবেলার নির্জনতায় লেক-এ রোয়িং করার সময়। গঙ্গায়। গোপালপুর অন সি-তে। নীল সোনালি রুপালি গোলাপির এক অদ্ভুত কারুকার্য!
ভুল। অলক জানে ভুল। বিশ শতকের এই ভাটিতে কে বিশ্বাস করবে জলকন্যার কথা? জলের বিভ্রম তাকে দেখায় ওই মরীচিকা। সে জানে। তবু দেখে। বারবার দেখে।
০৪. আজকাল বাড়িতে ঝগড়াঝাটি
আজকাল বাড়িতে ঝগড়াঝাটি, কুটকচালি বড় বেড়েছে। সারাদিন বাড়িময় শেকল আর ফিতে টেনে ঘুরে বেড়াচ্ছে কানুনগোর লোক। আর বশিষ্ঠ মাঝে মাঝে বিকট গলায় পেঁচিয়ে জানান দিচ্ছে, পাপ! পাপ!
বনানী শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ পড়ে দু’চোখ ভরা জল নিয়ে উঠল। তারপর চিনি-বউয়ের কাছে গিয়ে বলল, যুক্তাক্ষর শেখাবে আমাকে?
চিনি-বউ ঠোঁট টিপে হেসে বলল, শিখেই তো গেছিস। একটা আদর্শলিপি নিয়ে আসিস, দেখিয়ে দেব। খুব যে বই-পড়ার নেশা হয়েছে তোর!
কী ভালই যে লাগে!
বাড়িতে বড় অশান্তি চলছে। চেঁচামেচির কামাই নেই। বিশাল সংসার, অনেক বাসন-কোসন, সোনাদানা, অনেক জিনিস। ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে কথায় কথায় লেগে যাচ্ছে ভাইয়ে ভাইয়ে, বউতে বউতে। এমনকী ছেলেমেয়েগুলো পর্যন্ত বাদ নেই।
বনানীর একটা চমকা ভয় ধরে আজকাল। কী যে হবে! কোথায় যে যাবে!
লক্ষ্মীপিসিরও মেজাজ ভাল নয়। প্রায়ই বলে, আগুন লাগল। এখন দেখ, কতদূর পোড়া যায়।
আমার কী হবে পিসি?
তোর তো সুখের জীবন। এক আঘাটা থেকে আর-এক আঘাটায় গিয়ে উঠবি। তোর আর কী! বিপদ হল আমাদের, যাদের ঘটিবাটি আগলে দিন কাটে। সংসার যে কী নরক রে বাবা!
বর্ধমানে কী কাজে গিয়েছিল চিনি-বউয়ের দাদা। ফেরার সময় ইচ্ছে হল বোনের শ্বশুরবাড়িটা দেখে যেতে। তাই এসে হাজির এক শীতের সকালবেলায়।
চিনি-বউয়ের ঘরে চা গেল, চিড়েভাজা গেল, নারকেল কোরা গেল, ডিমসেদ্ধ গেল।
বনানীরও খুব ইচ্ছে হল যেতে। ডাক্তার মানুষ, যদি একটু তাকেও দেখে।
প্রথমটায় সাহস হল না। আজকাল তার ঘা নেই, ন্যাড়া মাথায় তিন মাসের চুল গজিয়েছে। চিনি বউ মিথ্যে বলেনি। তার আর কিছু না থাক, চুলের ঘেঁষটা ভাল।
একটা বেড়াল তাড়ানোর ভান করে অবশেষে গেলও বনানী। লোভ সামলাতে পারল না।
চিনি-বউয়ের দাদা ছেলেমানুষ। ডাক্তার বলে মনেই হয় না। একটা কাঠের চেয়ারে বসে সিগারেট খেতে খেতে বোনের সঙ্গে খুব কথা কইছে।
বনানীকে দেখে চিনি-বউ বলল, আয়, ভিতরে আয়। এই দেখ আমার দাদা।
দাদা বলতে চিনি-বউয়ের চোখে অহংকার ফুটল বেশ।
ঝলঝলে মরা শরীরটা নিয়ে বনানী চিনি-বউয়ের ডাক্তার দাদার সামনে দাঁড়াল। দরজা ঘেঁষেই।
মেয়েটা কে রে?
ও হচ্ছে বামুনের মেয়ে।
চিনি-বউয়ের দাদা এ কথা শুনে খুব হাসল। তারপর বলল, ওটা কারও পরিচয় হল নাকি? বামুনের মেয়ে না কায়েতের মেয়ে তাই বুঝি জানতে চাইছি?
চিনি বউ লজ্জা পেয়ে জিভ কাটল। তারপর বলল, ওর নাম হল বনানী। বাপটা মাতাল, সত্য দু’চোখে দেখতে পারে না। এ বাড়িতে কুকুর-বেড়ালের মতো পড়ে থাকে। চেহারাটা তো দেখছিস। পনেরো বছর বয়স কেউ বলবে?
পনেরো বছর কথাটা বনানীর নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু হিসেব করলে তাই দাঁড়ায়। তেরো বছর বয়সে এসেছিল এ বাড়িতে। পনেরোর বেশিই হবে এখন। আজও ঋতুমতী হয়নি। মেয়েমানুষ বলে বোঝাও যায় না তাকে।
চিনি-বউয়ের দাদা তখন ডাক্তারের চোখে দেখল তাকে খানিকক্ষণ। তারপর বলল, ম্যালনিউট্রিশনটাই প্রধান। টনসিল আছে বলে মনে হচ্ছে। এই, তুই এদিকে আয় তো!
বনানীর বুকের মধ্যে আশা, ভরসা, আনন্দ ঠেলাঠেলি করতে লাগল। ডাক্তাররা তো প্রায় ভগবান!
পরে সে জেনেছিল, চিনি-বউয়ের দাদার নাম শুভ্র। শুভ্র দাস। সেদিন তার বুক পিঠে চোঙা ঠেকিয়ে, চোখের পাতা টেনে, পেট টিপে অনেক কিছু দেখেছিল। মাথা নেড়ে বলল, তেমন কিছু সিরিয়াস বলে মনে হচ্ছে না। তবে ব্লাড় আর ইউরিনটা দেখলে বোঝা যেত।
ওই পর্যন্ত হয়ে রইল সেদিন। একজন ডাক্তার তাকে দেখল, কিন্তু কেমন ভাসা-ভাসা ভাবে। কোনও নিদান দিল না।
দাসশৰ্মাদের বাড়িতে তুলকালাম লাগল এর কিছুদিন পর থেকেই। ভাগাভাগি, টানাটানি, চিল-চেঁচানি, মারপিটের উপক্রম হল কতবার। অবশেষে উঠোনে তিনটে আজগুবি বেড়া উঠল। মুখ দেখাদেখি বন্ধ হল।