শরীরের সহনশক্তিরও কোনও সীমা নেই। কিছুকাল আগের একটা ঘটনা। ঝুমুর তার সঙ্গে সাঁতার শিখতে লেক এ যেত। ফুটফুটে মেয়ে, সাঁতারের পোশাকে তাকে বেশ রমণীয় দেখাত। লেক-এর ধারেকাছে বদ ছেলের অভাব নেই। একদিন গুটি পাঁচেক ছেলে ফেরার পথে তাদের পিছু নেয়।
প্রথমটায় টিটকিরি, দুটো-একটা অশ্লীল কথা ও ইঙ্গিতের পর তারা আরও একটু বাড়াবাড়ি শুরু করে দিল। রুখে দাঁড়াল ঝুমুর। তার চেঁচামেচিতে ছেলেগুলো একটুও ভড়কাল না, বরং একজন এসে টপ করে তার হাত ধরে এক পাক ঘুরিয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল, বোল রাধা বোল সঙ্গম হোগা কি নেহি–
অলক খুব বেশি কিছু করেনি। সে গিয়ে ছেলেটার হাত ধরে ফেলেছিল। হয়তো সে কিছুই করত না, হয়তো করত। কিন্তু সে কিছু করার আগেই সেই ছেলেগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। সে যে ঝুমুরের দাদা, প্রেমিক নয়, ওটা হয়তো তারা আন্দাজ করেনি। ফুটফুটে সুন্দর একটা মেয়ের সঙ্গে একজন শক্ত-সমর্থ পুরুষকে দেখেই সম্ভবত তাদের ঈর্ষা হয়ে থাকবে। একটু ছোট ইন্ধন দরকার ছিল তাদের।
অলক মারতে পারত উলটে। তার গায়ে যথেষ্ট জোর। কিন্তু সে মারেনি। শুধু ঠেকানোর চেষ্টা করেছিল। ঠোঁট ফাটল, নাক ফাটল, কপাল ফাটল, বুকে পিঠে লাগল শতেক ঘুসি ও লাথি। নীরবে সহ্য করে গেল অলক। শুধু এই ফাঁকে ঝুমুর দৌড়ে গিয়ে ক্লাবে খবর দেওয়ায় অলকের বন্ধুরা ছুটে আসে এবং পালটি নেয়। কিন্তু সে অন্য গল্প। শুধু এটুকু বলতে হয় যে, সেই কচুয়া ধোলাই থেকে অলক শিখেছিল যে, শরীর অনেক সয়।
দাদাকে ওরকম নির্বিকারভাবে মার খেতে দেখে ঝুমুরের বিস্ময় আর কাটে না। মারপিটের সময় সে একঝলক অলকের দু’খানা চোখ দেখতে পেয়েছিল। সেই চোখের বর্ণনা সে বোধহয় কোনওদিনই সঠিক দিতে পারবে না। ভয়হীন, নিরাসক্ত, উদাসীন অথচ উজ্জ্বল সেই চোখ দেখে কে বিশ্বাস করবে যে, কতগুলো ইতর ছেলের হাতে অলক মার খাচ্ছে। তা ছাড়া অলকের মুখে এবং চোখে একটা আনন্দের উদ্ভাসও দেখেছিল ঝুমুর।
কথাটা সে কাউকে বলেনি কখনও। কিন্তু অলককে সেই থেকে মনে মনে কেমন যেন ভয় পায় ঝুমুর। তার মনে হয়, দাদা স্বাভাবিক নয়। হয়তো পাগল। সঠিক অর্থে পাগল না হলেও মনোরোগী। আর তা যদি না হয় তো খুব উঁচু থাক-এর কোনও মানুষ।
মেয়েদের সঙ্গে অলকের সম্পর্ক সহজ ও স্বাভাবিক। বিভিন্ন মিট-এ মেয়ে সাঁতারুদের সঙ্গে দেখা হয়, আলাপ বা আড্ডা হয়, ঘনিষ্ঠতা ঘটে। তা ছাড়া ফ্যানরা আছে, আছে সাঁতারুদের বোন বা দিদি।
জানকী কেজরিওয়াল ছিল বড়লোকের আহ্লাদী মেয়ে। মোটামুটি ভালই সাঁতরাত। তাদের ছিল নিজস্ব সুইমিং পুল, একজন ব্যক্তিগত কোচ। এলাহি ব্যাপার। দেখতেও মন্দ ছিল না জানকী। একটু ঢলানি স্বভাব ছিল, এই যা।
সে একটু ঢলেছিল জানকীর দিকে, লোকে বলে। দিল্লিতে একটা ট্রায়ালের ব্যাপার ছিল। জানকী খারিজ হয়ে খুব কান্নাকাটি বাধিয়েছিল সেখানে। মায়াবশে একটু সান্ত্বনা দিতে হয়েছিল অলককে। সেই থেকে পরিচয়টা ঘনিষ্ঠতায় দাঁড়িয়ে যায়। জানকীর বাবার কোম্পানির একটা রেস্ট হাউজ আছে হাউজ খাস-এ। জানকী আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে, সুইসাইড করতে ইচ্ছে হচ্ছে, তুমি আমার সঙ্গে চলো এসব বলতে বলতে একরকম টেনে নিয়ে গেল সেইখানে। জানকীর দুঃখ কী ছিল বলা মুশকিল, তকে একেবারে চূড়ান্ত কাণ্ডটা ঘটানোর আগে অবধি সেই দুঃখ-দুঃখ ভাবটা তার যাচ্ছিল না। সারা রাত দু’জনে এক বিছানায় কাটানোর পর সকালে অলক জানকীকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল, তোমার শরীরের মধ্যে শরীর ছাড়া আর কিছু নেই?
বস্তুত সারা রাত ধরে জানকীর মধ্যে ড়ুব দিয়ে অলক একটা কিছু খুঁজেছিল। এমন কিছু যা ভোগে ক্লান্তি আনে না, যা কিছুটা দেহাতীত, কিছুটা রহস্যাবৃত। জীবনের প্রথম সংগম তাকে প্রায় কিছুই দিল না।
এরকম কয়েকবার ঘটেছে অলকের। মেয়েদের ব্যাপারে তার আগ্রহ থাকলেও উদ্যম নেই। সে কারও পিছনে ঘোরে না। কিন্তু জুটে যায়। প্রতিবারই সংগম-শেষে এক হাহাকারে ভরে যায় অলক, এক বিতৃষ্ণা ও বিষণ্ণতায় তার শরীর ভেঙে পড়ে। সে কেন অনুভব করে এক পরাজয়ের গ্লানি? এটা কোনও পাপবোধ নয়। সে অনুভব করে কোনও শরীরেরই তেমন গভীরতা নেই যাতে ড়ুবে যাওয়া যায় আকণ্ঠ। জলের মতো শরীর নেই কেন কোনও মেয়ের?
এক বন্ধুর অ্যারেঞ্জমেন্টে তারা অর্থাৎ সাঁতারুদের একটা দল সেবার গেল সরকারি লঞ্চে চেপে সুন্দরবনে বেড়াতে। দু’দিনের চমৎকার প্রোগ্রাম। খাও, দাও, জঙ্গল দেখো, গান গাও বা ঘুমাও। আছে আচ্ছা, তাস, ড্রিংকস।
শুধু জলে নামা ছিল বারণ। মোহনার নদী এমনিতেই লবণাক্ত, তার ওপর কুমির, কামট, হাঙরের অভাব নেই। ডেক-এ দাঁড়িয়ে আদিগন্ত জল আর প্রগাঢ় অরণ্য দেখতে দেখতে কেমন
অন্যরকম হয়ে গেল অলক। গভীর জল, গভীর আকাশ, গভীর অরণ্য।
শেষ রাতে একদিন চুপি চুপি উঠে পড়ল অলক। মাঝদরিয়ায় নোঙর ফেলে দাঁড়িয়ে আছে লঞ্চ। চারদিকে শীতের কুয়াশা, নিথর জল, অদূরে অরণ্যের গভীরতা। এক অলৌকিক আবছায়ায় চারিদিক মায়াময়।
ঝাঁপ দিলে জলে শব্দ হবে, তাই একটা দড়ি ধরে ধীরে ধীরে জলে নেমে গেল অলক। কুমির হাঙর, যাই থাক, জলে সে কখনও ভয় খায় না। শীতের ভোরে ঠান্ডা নোনা জল যখন তার শরীরে কামড় বসাল তখনও তেম। খারাপ লাগল না তার! দু’হাতে জল টেনে সে নিঃশব্দে এগিয়ে যেতে লাগল তিরবেগে। কোথায় যাচ্ছে তা জানে না।