অলককে পেয়ে পিসির সেই অভাবটা মিটল। এই ঠান্ডা সুস্থির ভাইপোটাকে অপ্রয়োজনে দেদার জিনিস কিনে দিয়ে সোনালি প্রায় পাগল করে দিল।
একদিন অলক বিরক্ত হয়ে বলল, আমার জন্য রানিং বুট কিনেছ কেন? রানিং বুট দিয়ে আমার কী হবে?
বিস্মিত সোনালি বলে, কেন, তুই দৌড়োস না?
দৌড়োব কেন? আমি তো সাঁতরাই।
সাঁতারুদের দৌড়োত হয় না বুঝি? আমাকে স্কুলের গেম-টিচার বলেছিল সাঁতারুদের দৌড়োতে হয়। একসারসাইজ করতে হয়।
ধুস! ওসব কিছুই লাগে না। ঠিক আছে, কিনেছ যখন, মাঝে-মাঝে দৌড়োব।
জলে ভাসে এমন একটা দাবার ছক তাকে একদিন কিনে দিল সোনালি। বলল, জলে সাঁতরাতে সাঁতরাতে খেলবি।
অলক দাবার ছকটা দেখে চোখ কপালে তুলে বলল, এর যে অনেক দাম!
তাতে কী?–উদাসভাবে বলল সোনালি।
এ ছাড়া দামি পোশাক, ভাল জুতো, হাতঘড়ি এসব প্রায়ই কিনে দেয় সোনালি। আর এইসব দেয়া-থোয়া নিয়ে মনীষা গুজরাতে থাকে বেহালায়। তার ধারণা, এইভাবে দাদু-ঠাকুমা আর পিসি অলককে তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তার প্রশ্ন, কেন? আমরা কি ছেলেকে কিছু কম দিই? কিন্তু মনীষা কখনও এমন কথা অলককে বলতে পারে না যে, ওদের কাছ থেকে নিস না। কথাটা বলা যায় না। শত হলেও ওরা অলকের আপন ঠাকুমা-দাদু, আপন পিসি। কথাটা বললে হয়তো অলক তেমন খুশি হবে না।
এ বাড়িতে সকলেই অলকের প্রিয় বটে, কিন্তু তার আসল আকর্ষণ ঠাকুমা। তার প্রতি ঠাকুমার ভালবাসাটা ক্ষুধার্তের মতো। ভীষণ ঝাঁঝালো, দ্বিধাহীন এবং প্রত্যক্ষ সেই স্নেহ। সে এলে ঠাকুমা কেমন ডগমগ হয়ে ওঠে, অনেক বকে এবং রাজ্যের খাবার করতে বসে যায়। কাছে বসিয়ে অনেক প্রশ্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে।
ঠাকুমার প্রতি অলকের আকর্ষণের আর-একটা কারণ হল, জল। সে আবিষ্কার করেছে ঠাকুমাও তার মতোই জল ভালবাসে। ঠাকুমা বলে, সুযোগ পেলে আমি কবে আরতি সাহার মতো ইংলিশ চ্যানেল পেরিয়ে যেতাম।…পুরীতে যখন প্রথম সমুদ্র দেখি তখন ভয়ে সবাই অস্থির। আমার একটুও ভয় করল না। নুলিয়া না নিয়েই দিব্যি নেমে পড়লাম জলে।… ছেলেবেলায় যখন পুকুরে ড়ুবসাঁতার কাটতাম তখনকার মতো আনন্দ বোধহয় আর কোনও কিছুতেই ছিল না।
ঠাকুমা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করে, ওরা তোকে ঠিকমতো খেতে-টেতে দেয়?
দেবে না কেন?
তোর মা রাধে আজকাল?
রাঁধে। মাঝে মাঝে।
রান্নার লোক নেই এখন?
মাঝে মাঝে এক-আধজন রাখা হয়। সে কিছুদিন বাদে ঝগড়া করে চলে যায়। ফের কিছুদিন বাদে একজনকে রাখা হয়। এইরকম আর কী!
তোর অফিসের ভাত বেঁধে দিতে পারে?
অলক হাসে, না। আমি তো দুপুরে অফিসের ক্যান্টিনে খেয়ে নিই। তুমি অত খাওয়া-খাওয়া করো কেন?
ঠাকুমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, সাঁতারে যে অনেক দম লাগে। খাওয়ার দিকে নজর না দিলে বাঁচবি নাকি?
দাদু, ঠাকুমা, পিসির সঙ্গে অলকের এই টান-ভালবাসার কথা খুব ডিটেলসে না জানলেও আন্দাজ করতে পারে মনীষা। অনুমান করতে পারে তার দিদি মধুরা অর্থাৎ নূপুর এবং বোন প্রিয়াঙ্গি অর্থাৎ ঝুমুর। এবং শোধ নেওয়ার জন্যই বোধহয় একসময়ে মনীষা উঠে-পড়ে অলকের যত্ন নিতে শুরু করে। রোজ ভাল ভাল রাঁধতে থাকে, মেটে চচ্চড়ি, মুরগির সুপ, টেংরির ঝোল ইত্যাদি। বিনা উপলক্ষেই একটা টু-ইন-ওয়ান উপহার দিয়ে বসে তাকে তার বাবা সত্যকাম। খুব বেশিরকম আদর দেখাতে থাকে ঝুমুর।
তার চেয়েও মারাত্মক কাণ্ড করে বসে নূপুর। রোজ সকালে উঠে সে ভাইয়ের মেডিকেল চেকআপ শুরু করে দেয়। আর তাই করতে গিয়েই একদিন সে বিকট চেঁচিয়ে ওঠে, মা! বাবা! শিগগির এসো!
সবাই যথাবিধি ছুটে এসে জড়ো হয় এবং নুপুর ঘোষণা করে, অলকের হার্ট বড় হয়ে গেছে। হি নিডস ইমিডিয়েট মেডিকেল অ্যাটেনশন। সাঁতার বন্ধ।
কথাটা মিথ্যেও নয়। নুপুর নিজেই যখন একজন মস্ত হার্ট স্পেশালিস্টকে দিয়ে পরীক্ষা করাল অলককে তখন তিনিও বললেন, হার্ট বিপজ্জনক রকমের এনলার্জড। সম্ভবত সার্জারি কেস।
খবর পেয়ে অলকের সাঁতারু বন্ধুরা চলে এল। এলেন কোচ নিজেও। দু’দিন বাদে ন্যাশনাল ওয়াটারপোলো শুরু হবে। অলক বেঙ্গল টিমের অপরিহার্য খেলোয়াড়। কোচের না এসে উপায় কী! তবে এনলার্জড হার্টের কথায় তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, সাঁতারুদের হার্ট তো বড় হওয়ার কথা, যেমন হয় লং ডিসট্যান্স রানারদের। যাই হোক আপনারা ভাববেন না। খেলোয়াড়দের আলাদা ডাক্তার আছে, আমি তাকে আনাচ্ছি।
তিনি এলেন এবং একটু পরীক্ষা করেই অলককে বিছানা থেকে টেনে তুলে বললেন, যাঃ, জলে নাম গে। কিস্যু হয়নি। তঅর কলজে বড় হবে না তো কি পাঁঠার কলজে বড় হবে?
সেই থেকে বাড়ির যত্ন আবার কমে গেল। কিন্তু দুই বাড়ির তাকে নিয়ে এই কমপিটিশনটা মনে রইল অলকের। কিছু বলেনি কখনও, কিন্তু মাঝে মাঝে সে আপনমনে হেসে ফেলে। কিন্তু এই ‘অসুখ অসুখ’ রবে তার একটা ক্ষতিও হল। দিদি নূপুর যেদিন তার হার্ট বড় হয়েছে বলে ঘোষণা করল, সেদিন থেকেই সে ভীষণ অসুস্থ বোধ করতে শুরু করেছিল। বাঁ বুকে একটা অস্বস্তি এবং সেই সঙ্গে মনের মধ্যে ভয়। সেই অলীক অসুস্থতার মানসিক ধাক্কাটা বড় কম নয়। অসুখ হওয়াটা বড় কথা নয়, তার চেয়ে ঢের বেশি বড় হল অসুখ-অসুখ ভাবটা। কেন এই শরীর ধারণ তা অনেক ভেবে দেখেছে অলক। ব্যাধিময়, ব্যথাময়, নশ্বর এই শরীর নিয়ে মানুষের কত না ভাবনা। কিন্তু এই শরীরখানা দেওয়া হয়েছে এটাকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেওয়ার জন্যই, বসিয়ে রাখা বা আরাম করার জন্য,তো নয়।