হ্যাঁ। চাটুজ্জে।
লেখাপড়া শিখেছিস?
না গো, পাঠশালায় পড়তাম। তারপর আর হয়নি।
একটু-আধটু পড়তে পারিস তো?
যুক্তাক্ষর তেমন পারি না।
বিয়েতে আমি কয়েকটা বই পেয়েছি। সবই বাজে বই। ভাবছিলাম কাকে দিয়ে জঞ্জাল সরাব। তা তুই দুটো নিয়ে যা। বুঝিস, না বুঝিস, পড়ার চেষ্টা কর। না পারলে আমাকে জিজ্ঞেস করে নিস।
নতুন বউ যা বলে সবই তার শিরোধার্য মনে হয়। বনানী বই আর ওষুধ এনে তার পাটাতনের আস্তানায় সযত্নে লুকিয়ে রাখল।
এই মরা-মরা জীবনেও মাঝে মাঝে এরকম ঘটলে একটু কেমন বাঁচার ইচ্ছে জাগে। বই বা ওষুধ, ওগুলো কিছু নয়। আসল হল ওই আদরকাড়া কথা। প্রাণটা নিংড়ে যেন জল বের করে আনে চোখ দিয়ে। এটুকু, খুব এইটুকু আদর পেলেও বনানীর মনে হয় অনেকখানি পেয়ে গেল সে। আর বুঝি কিছু চাওয়ার নেই।
চিনি আর-একদিন বলল, মাথা সব সময় ন্যাড়া করিস কেন?
ঘা যে!
ঘা সারিয়ে ফেল তাড়াতাড়ি। তোর খুব ঘেঁষ চুল। অত চুল আমার মাথায় নেই। চুল হলে তোকে বেশ দেখাবে।
ওম্মা গো। বনানী লজ্জায় মুখ ঢাকে। সে বলে আধমরা, তাকে চুল দেখাচ্ছে চিনিবউ! লজ্জাতেই মরে যাবে সে।
আশ্চর্য! অয়েন্টমেন্টে বেশ কাজ দিতে লাগল। কয়েকদিন খুব যত্ন করে লাগিয়েছিল বনানী। ঘায়ে টান ধরল। মামড়ি খসতে লাগল। কালো হয়ে এল দগদগে ঘায়ের মুখ।
যুক্তাক্ষর বিশেষ ছিল না বলে একটা বই টানা পড়ে শেষ করে ফেলল বনানী। ছোটদের জন্য সহজ করে লেখা বঙ্কিমের রাজসিংহ। কী সুন্দর যে গল্পটা! বনানী আবার পড়ল।
পড়ে খুবই অবাক হয়ে গেল বনানী। একটা বাঁধানো বই যে সে আগাগোড়া পড়ে উঠতে পারবে এ তার ধারণার বাইরে ছিল।
শুধু বেঁচে থাকতে পারলে, কোনওরকমে কেবলমাত্র বেঁচে থাকতে পারলেও জীবনে কত কী যে হয়।
০৩. হেদুয়ায় এলে অলক
হেদুয়ায় এলে অলক একবার দাদুর বাড়ি হানা না দিয়ে যায় না।
বাপ আর ছেলের মধ্যে যেমন জেনারেশন গ্যাপ থাকে, দাদু আর নাতির মধ্যে তেমনটা না থাকতেও পারে। বাপ আর ছেলে সব সময়েই সরাসরি সংঘর্ষের সম্ভাবনার মধ্যে থাকে। দাদু আর নাতির সেই ভয় নেই। প্রজন্মগত পার্থক্যটা বেশি হওয়ার দরুনই বোধহয় তাদের মধ্যে এক সমঝোতা গড়ে ওঠে।
অলকের দাদু সৌরীন্দ্রমোহন কমার্শিয়াল আর্টিস্ট ছিলেন। সে আমলে তার পেশায় তেমন পয়সা ছিল না। তবু সৌরীন্দ্রমোহন কিছু টাকা করতে পেরেছিলেন সিনেমা থিয়েটারে কাজ করে এবং একটা ফোটোগ্রাফির স্টুডিয়ো চালিয়ে। স্টুডিয়ো বেচে দিয়েছেন, এখন আর আঁকেন না। বয়স পঁচাত্তর। তিন ছেলে এবং এক মেয়ের বাবা। সাহিত্য পরিষদ স্ট্রিটের বাড়িটা কিনেছিলেন। পঁয়তাল্লিশ সালে। সেই বাড়ি নিয়েই ছেলেদের সঙ্গে বখেরা।
সৌরীন্দ্রমোহনের মেয়ে সোনালির বিয়ে হয়নি। সোনালি দেখতে ভাল নয়, উপরন্তু তার পিঠে একটা কুঁজ থাকায় বিয়ে বা সংসারের স্বপ্ন সে ছেলেবেলা থেকেই দেখে না। সৌরীন্দ্রমোহন মেয়ের ভবিষ্যৎ ভেবে বাড়িটা তার নামে লিখে দেন এবং নিজের টাকাপয়সার সিংহভাগটাই তার নামে ব্যাংকে জমা করেন। ছেলেরা গর্জে উঠল, আপনি কি ভাবেন সোনালিকে আমরা দেখব না?
এই ঝগড়া দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তবে ছেলেরা লায়েক হয়ে যে যার আলাদা এস্টাবলিশমেন্ট করে চলে গেছে। এমনিতেও আজকাল পৈতৃক বাড়িতে ছেলেরা থাকতে চায় না। সৌরীন্দ্রমোহন জানেন, তার ছেলেরাও আলাদা হতই, সোনালি উপলক্ষ মাত্র।
সুতরাং উত্তর কলকাতার এই বাড়িতে সৌরীন্দ্রমোহন, তার স্ত্রী ও মেয়ে মোট এই তিনটি প্রাণী। ছেলে বা নাতি-নাতনিরা কেউই আসে না। সম্পর্ক একরকম চুকেবুকে গেছে।
এই পুরনো নোনাধরা প্রকৃতিহীন বাড়ি এবং তার অভ্যন্তরের তিনটি প্রাণীর প্রতি অলকের এক ধরনের টান আছে। হেদুয়ায় যখনই তার সাঁতার থাকে তখনই সে একবার দাদু আর ঠানুর কাছে হানা দেয়।
সৌরীন্দ্রমোহন তাঁর এই গম্ভীর ও ঠান্ডা প্রকৃতির নাতিটার ওপর এক প্রগাঢ় মায়া অনুভব করেন। ছেলেদের ওপর থেকে যে স্নেহ প্রত্যাহার করার নিষ্ফল চেষ্টায় ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছিলেন তা এই একটি অবলম্বন পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। তবে তার প্রকৃতি গম্ভীর বলে বাইরে তেমন প্রকাশ নেই।
সৌরীন্দ্রমোহনের স্ত্রী বনলতা একটু সেকেলে। নাতির তিনি আর কিছু বুঝুন না বুঝুন, শুধু এটুকু বোঝেন যে, ছেলেটা নিজেদের বাড়িতে তেমন ভাল-মন্দ খেতে পায় না। বনলতা একটু ঠোঁটকাটাও বটে। কথায় কথায় তিনি মনীষার উল্লেখ করেন নাচনেওয়ালি’ বলে। ৩ার ধারণা, নাচনেওয়ালির কি আর সংসারে মন আছে? সে কেবল নেচে আর নাচিয়ে বেড়ায়। বনলতার দৃষ্টিভঙ্গি পুরনো আমলের বলেই তার মূল্যবোধ অন্যরকম। তার মতে, গুছিয়ে সংসার করা, ভাল-মন্দ রাঁধা এবং পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হওয়াই মেয়েদের ধর্ম। সেই বিচারে মনীষা একেবারেই ধোপে টেকে না। বাস্তবিকই মনীষা রান্নাবান্না বা খাওয়া-দাওয়াকে তেমন গুরুত্ব দেয় না। অনেক সময়ে দোকানের খাবার আনিয়ে এক-আধবেলা চালিয়ে নেয়। রান্নাঘরে বাঁধা পড়লে তো তার চলবে না। বনলতা। তাই নাতি এলেই খাবার করতে বসেন এবং পেট পুরে খাওয়ান তাকে। অলক বিনাবাক্যে খেয়েও নেয়।
পিসি সোনালি ইংরিজির এম এ। শারীরিক ত্রুটির ফলেই কি না কে জানে তার মেজাজ সাংঘাতিক তিরিক্ষি। মা-বাপকে সে রীতিমতো শাসনে রাখে। একটু কিছু হলেই সে রেগে আটখানা হয়, নয়তো কাঁদতে বসে। স্থৈর্য, ধৈর্য, সহনশীলতা তার খুবই কম। কিছুদিন আগে সোনালি একটা স্কুলে চাকরি পেয়েছে। সময়টা কাটে ভাল। কিন্তু তার একটাই অসুবিধে, টাকা খরচ করার মতো যথেষ্ট উপলক্ষ খুঁজে পায় না। শাড়ি গয়না ইত্যাদিতে তার আকর্ষণ নেই, সে রূপটান ব্যবহারই করে না। তা হলে একটা মেয়ে খরচ করবে কীসে? অনেক সময়ে প্রিয়জন কাউকে কিছু দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু তার প্রিয়জনই বা কে আছে?