কাগজটা এখনও যত্ন করে রেখে দিয়েছে বনানী। একবার বাবাকে দেখিয়েছিল। বাবা উদাস হয়ে বলল, তোকে বাঁচাবে কে বল? মবতেই জন্মেছিস।
মরতেই যে তার জন্ম এটা বনানী খুব ভাল করে জানে। বেঁচে থাকতে পারে তারাই যাদের বেঁচে থাকাটা অন্য কেউ চায়। যাদের ভালবাসার লোক আছে। বনানীর তো সেরকম কেউ নেই। কে চাইলে যে সে বেঁচে থাকুক?
আর এই রোগা ঝলঝলে শরীর, এটা নিয়েই বা কী করে সে বেঁচে থাকবে তা বোঝে না বনানী। বড্ড অসাড, বড্ড ঠান্ডা তার শরীর। বর্ষায়, শীতে গাঁটে গাঁটে একরকম ব্যথা শেয়ালের কামড়ের মতো তার হাড়গোড় চিবোয়। এক-এক সময়ে শোয়া থেকে উঠতে পারে না কিছুতেই শত চেষ্টাতেও। জেগে থেকেও এক-এক সময়ে তার মনে হয়, মরে গেছে বুঝি!
বনানী অ আ ক খ শিখেছিল সেই কবে। বাবা তখন মা-মরা মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে মাথা চেপে ধরে কত আদর করে শেখাত। পাঠশালাতেও ভরতি হয়েছিল সে। তারপর মাসি এল। একটা ঝড় যেন সব উলটে-পালটে দিয়ে গেল।
দাসশৰ্মাদের বাড়িতে বনানী কেমন আছে? বেশ আছে, যতদিন থাকা যায়। কিন্তু সে খুব বোকা-বোকা দেখতে হলেও ততটা বোকা নয়। সে টের পায় বশিষ্ট দাসশর্মার এই সুখের সংসার খুব বেশিদিন নয়। তারা চার ভাই। অন্য তিন ভাইয়ের সঙ্গে বশিষ্ঠর তেমন বনিবনা হচ্ছে না। চারদিকে একটা গুজগুজ ফুসফুস উঠেছে, বাড়ি ভাগ হবে, হাঁড়ি আলাদা হবে, বিষয়-সম্পত্তির বাঁটোয়ারাও হবে সেই সঙ্গে। কদিন হল শহর থেকে উকিল আসছে, কানুনগো আসছে।
লক্ষ্মীপিসি মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার ঘরখানা যে কার ভাগে পড়বে! বশিষ্ঠর ভাগে পড়লে রক্ষে। অন্য তিনজনের কেউ হলে ঝটা মেরে তাড়াবে।
এ ভয়টা একটু একটু বনানীও পায়। বাড়ি যখন ভাগ হয় তখন লোকজনও ভাগ হয়। চাকর ঝি মুনিশ জন সব ভাগ হয়। বনানীকে নেবে কে? কেউ কি নেবে? যদি বশিষ্ঠ দাসশর্মা নেয়ও তখন আর এমন বসে কাজে ফাকি দিয়ে দিন কাটাতে পারবে কি সে? তখন তো ভাগের সংসারে এত লোক থাকবে না, গা ঢাকা দেওয়াও চলবে না। তখন তাকেও তাড়াবে।
সংসারে কাজেরই আদর, বনানী জানে। তার ইচ্ছেও যায়। কিন্তু পারলে তো! শরীরে যে দেয় না।
মাসি বিষ দিয়েছিল বেশ করেছিল। পুরোটা যদি মুখ চেপে ধরে খাইয়ে দিত, আর হেলথ সেন্টারের সেই ডাক্তারবাবুটি যদি ভাল মানুষ না হত তা হলে একরকম বেঁচে যেত বনানী। বিষটা অল্প ছিল বলে আর বাবা বানিয়ে একটা গল্প বলেছিল বলে থানা-পুলিশ হয়নি। সে মরলে কিন্তু হত। মাসির ফাঁসিই হত হয়তো-বা। তাতে বাবাটা বেঁচে যেত।
এ বাড়ির সামনে দিয়েই বাবা সকাল-বিকেল যায় আসে। আগে আগে ওই সময়টায় রাস্তার ধারে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকত বনানী। বাবাকে দেখলেই আহ্লাদে চিৎকার দিত, বাবা গো!
বাবা খুশি হত কি না বলা যায় না। তবে মরা চোখে তাকাত। একটু দাঁড়াত সামনে। মাথায় একটু হাত দিত। সে সময়ে বাবার কাঁচাপাকা চুল, অল্প সাদাটে দাড়ি, শুকনো মুখ আর জলে-ডোবা চোখ
দেখে বড় মায়া হত বনানীর। এই একটা লোক হয়তো চাইত, বনানী বেঁচে থাক।
বাবা এখনও যায় আসে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে গেলে বনানী গিয়ে রাস্তার ধারে দাঁড়ায়। দুটো কথা বলে। দেখা হয় মুদির দোকানে বা কয়লার ডিপোয়। একটা-দুটোর বেশি কথা বলে না বাবা। কীই বা বলার আছে! এক-এক সময়ে কি মানুষের কথা একেবারে ফুরিয়ে যায়? নিজের বাবাকে দেখে সেরকমই মনে হয় বনানীর। তার মা যখন মরে যায় তখন সে ছোট্টটি। চঞ্চল দুরন্ত মেয়ে বলে বাবা পায়খানায় যাওয়ার সময়ও তাকে কোলে করে নিয়ে যেত। পাছে ঘরে রেখে গেলে কোনও বিপদ ঘটায়। সেইসব কথা মনে আছে বনানীর। সেই বাবাই তো তাকে বেড়াল-পার করে দিয়েছে এ বাড়িতে।
মরবে বনানী। মরতেই তার জন্ম।
উঠোনে লক্ষ্মীর পায়ের মতো জলছাপ ফেলে পুকুরঘাট থেকে কে যেন ঘরে গেছে।
কী ছোট্ট আর কী সুন্দর নিখুঁত সে পায়ের পাতার গড়ন! বনানী চিহ্ন ধরে ধরে এগোয়। জানে এ পা হল বশিষ্টর বড় ছেলে শুভবিকাশের নতুন বউ চিনির।
নতুন বউ মাত্রই ভাল। কী যে অদ্ভুত নতুন বউয়ের গায়ের গন্ধ, মুখের লজ্জা-রাঙা ভাব, রসের হাসি। চিনি তাদের মধ্যেও যেন আরও ভাল। দূর ছাই করে না, হাসিমুখে কথা কয়। তার ঘরের কাছে আজকাল একটু বেশিই ঘুর ঘুর করে বনানী। হুট করে ঘরে ঢোকে না, অত সাহস তার নেই।
আজও দাওয়ায় উঠে কপাটের আড়াল থেকে দেখছিল বনানী। চিনি জানালার ধারে টেবিলের ওপর ঝুঁকে কষে সিঁদুর দিচ্ছে সিথিতে। নতুন বউরা খুব সিদুর দিতে ভালবাসে।
চোখে চোখ পড়তেই চিনি হাসল। ডাকল, আয়। ভিতরে আয়।
বনানী ঘরে ঢোকে। দরজার গায়েই দাঁড়িয়ে থাকে।
চিনি ফিরে তাকাল, তোর ঘা-গুলো সারে না, না রে?
না।
চুলকোয়?
মাঝে মাঝে চুলকোয়।
ওষুধ দিস না?
না। মাছি বসে বলে শুকোয় না। নইলে—
তোর মাথা। আমার কাছে একটা পেনিসিলিন অয়েন্টমেন্ট আছে, নিবি? লাগিয়ে দেখ তো কয়েকদিন। না শুকোলে বলিস। আমার দাদাকে লিখে দেব, ওষুধ পাঠিয়ে দেবে। আমার দাদা কলকাতার ডাক্তার।
ডাক্তারদের প্রতি একটা খুব শ্রদ্ধাবোধ আছে বনানীর। চিনি ডাক্তারের বোন জেনে সে খুব ভক্তিভরে চেয়ে রইল।
চিনি উঠে একটা ছোট বাক্স খুলে নতুন একটা টিউব তার হাতে দিয়ে বলল, ঘা ভাল করে সাবান দিয়ে ধুয়ে শুকনো করে মুছে লাগাবি।
ঘাড় নেড়ে বনানী বলে, আচ্ছা।
তুই নাকি বামুনের মেয়ে?