চুরি করে খাওয়া তার স্বভাবে ছিল না কখনও। কিন্তু খিদের কষ্টটা এমন অসহ্য লাগত যে বনানী সামলাতে পারত না। একদিন ছোট বোনের হাত থেকে বিস্কুট নিয়ে খেয়েছিল বলে মাসি তাকে হেঁটমুড় করে বেঁধে রাখে। আর তাই নিয়ে বাবা খেপে গিয়ে মাসিকে দা দিয়ে কাটতে যায়। আর তারই শোধ নিতে মাসি বনানীকে ভাতের সঙ্গে ইঁদুর-মারা বিষ খাওয়ানোর চেষ্টা করে। বনানী মরেই যেত, হেলথ সেন্টারের ডাক্তারবাবুটি ভাল লোক বলে তাকে বাঁচিয়ে দেয়। এরপরই বাবা ঠিক করে ও বাড়িতে বনানীকে আর রাখা ঠিক হবে না। তবে তার বাবা গগন চাটুজ্যে গরিব মানুষ, বিষয়-আশয় নেই। মেয়ের জন্য তেমন কিছু ব্যবস্থা করার সাধ্য ছিল না তার। তবে বশিষ্ঠ দাসশর্মার সঙ্গে তার খুব ভাব-ভালবাসা। সব শুনেটুনে দাসশর্মা বলেছিলেন, আমার বাড়িতেই দিয়ে দাও। কত লোক থাকে খায়, ওই রোগা মেয়েটা থাকলে কেউ টেরও পাবে না। বামুনের একটা মেয়ে থাকলে ভালই হবে। গুরুদেব আসেন, বামুন অতিথ-বিতিথ আসেন, বামুনের মেয়ে থাকলে সুবিধেও হবে।
বছর দুই আগে একটা পুঁটলি বগলে করে বাপের পিছু পিছু এসে সে এ বাড়িতে ঢোকে। ভারী মজার বাড়ি। চারদিকে কত লোক, কত মেয়েমানুষ, কত ছানাপোনা, কাচ্চাবাচ্চা। বনানী এ বাড়িতে আগেও এসেছে। তখন অন্যরকম ভাব ছিল। এবার এল কাজের মেয়ে হিসেবে। মাথা তাই নোয়ানো, লজ্জা-লজ্জা ভাব। তবে কিনা তার মতো অবস্থার মেয়ের বেশি লজ্জা থাকলে চলে না।
রোগাভোগা সে ছিলই। এখানে এসেও শরীরটা আর সারল না। তবে তার শরীর নিয়ে কারই বা মাথাব্যথা? বনানী ছুটতে পারে না, ভারী কাজ করতে পারে না, হাঁফিয়ে পড়ে। এ বাড়িতে তার যত্ন নেই, অযত্নও নেই। ঝি-চাকরদের সঙ্গেই তার খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। সে খাওয়া খারাপ নয়। ডাল, ভাত, তরকারি, কখনও-সখনও মাছ, কালেভদ্রে দুধ এবং পাশাপার্বণে পিঠে-পায়েস বা পোলাও। বেশ আছে বনানী।
সকালে ঘুম ভেঙে উঠতে বড় কষ্ট হয় বনানীর। শরীরটা যেন বিছানার সঙ্গে লেপটে থাকতে চায়। মাথা তুললেই টলমল করে। অথচ এই ভোরবেলাটায় বাইরে ফিকে আলোয় পৃথিবীটা দেখলে তার বুক জুড়িয়ে যায়। এ সময়টা তার শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করে না।
উঠে প্রথমেই সে বিছানাটা দেখে, পেচ্ছাপ করে ফেলেছে কি না। যদি করে ফেলে থাকে তবে তার মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়। আর যেদিন না করে সেদিন তার মনটা বড় ভাল থাকে।
পুকুরধারে পৈঠায় বসে ছাই দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে যখন সে কালো জলে ভোর আকাশের ছায়া দেখে তখন তার মনটা কেমন শান্তিতে ভরে ওঠে। তার রোজ এ সময়ে মনে হয়, জলে আকাশে বাতাসে মউ মউ করছে ভগবানের গায়ের গন্ধ! তার মনে হয়, আমি কোনওদিন মরব না।
বশিষ্ঠ দাসশর্মার এক বিধবা দিদি আছে। এ বাড়িতে যেমন কিছু বাড়তি লোক থাকে, ঠিক তেমনই। এইসব বাড়তি লোকের কোনও আদরও নেই, আবার অনাদরও নেই। আছে, থাকে, এইমাত্র। এই বিধবা দিদিটি থাকে একখানা মাটির ঘরে। নিঃসন্তান, একা। সকালের দিকে বনানী তার ঘরে হানা দেয়।
ও লক্ষ্মীপিসি, কী করছ গো?
লক্ষ্মীপিসি এ সময়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে আসন পেতে বসে মালা জপেন। সাড়া দেন না। বনানী বালতিতে গোবর গুলে দাওয়াটা নিকিয়ে দেয়। উঠোন ঝেটিয়ে দেয়। দাওয়ার কোলে লক্ষ্মীপিসির বেড়াঘেরা রান্নাঘরে গিয়ে কাঠের উনুনে জ্বাল তুলে সসপ্যানে চায়ের জল বসায়।
চা যেই হয়ে যায় লক্ষ্মীপিসির মালার জপও সেই শেষ হয়।
তারপর দুজনে দুটো কাসার গেলাসে চা নিয়ে বসে দাওয়ায়। বেশ গল্পটল্প হয় তাদের। তবে মেয়েমানুষের কথাই বা কী, কূটকচালি ছাড়া! লক্ষ্মীপিসি বসে বসে সংসারের নানাজনের নানা কথা খানিক বাড়িয়ে, খানিক রাঙিয়ে, কখনও-বা বানিয়ে বলতে থাকে। আর বনানী হু হুঁ করে যায়। কোটনামি করলেও লক্ষ্মীপিসি লোকটা তেমন খারাপ নয়। তার একখানা গুণ হচ্ছে, অসাধারণ সেলাইয়ের হাত। সেলাই আর বোনা দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। সেলাই করে আর সোয়েটার বা লেস বুনে তার কিছু আয় হয়। সুতরাং লক্ষ্মীপিসি একেবারে ফ্যালনাও নয়, গলগ্রহও নয়। মাঝে মাঝে পিসি বলেন, আমার যা আছে সব তোকে দিয়ে যাব।
বনানী এ কথাটা ভাল বোঝে না। লক্ষ্মীপিসিরটা সে পাবে কেন? পিসির তো অনেক আপনজন আছে। সে অবাক হয়ে বলে, আমাকে দেবে কেন পিসি? তোমার তো মদন আছে, ফুলু আছে, মণিপান্তি আছে।
আছে! সারাদিনে একবার খোঁজ নিতে দেখিস? এই যা সকালে এসে তুই-ই একটু খোঁজখবর করিস। তোকেই সব দেব আমি। তুই ভাল করে ডাক্তার দেখিয়ে চিকিৎসা করাবি।
এ কথাটায় একটু শিহরিত হয় বনানী। ডাক্তাররা তার কাছে জাদুকর, ভগবান। ওষুধ হল অমৃতস্বরূপ। সে জানে একজন ভাল ডাক্তার যদি তাকে দেখে ওষুধ দেয় তবে তার এই রোগাভোগা শরীরে রক্তের বান ডাকবে। মণিপান্তিরা যেমন বুক ফুলিয়ে ডগমগ হয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেরকম ঘুরে বেড়াতে পারবে সেও। একবার এক ডাক্তারই না তাকে ফিরিয়ে এনেছিল মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে! কিন্তু এই জীবনে ডাক্তার দেখানোর কথা বনানী ভাবতেই পারে না। কত টাকা খরচ হয় ডাক্তার দেখাতে!
চুরি করে একবার হেলথ সেন্টারে গিয়েছিল সে। আগের ডাক্তারটি আর নেই। নতুন একজন গোমড়ামুখো ডাক্তার তাকে বিশেষ পাত্তা দিল না। ঘায়ের জন্য একটু মলম দিল, ব্যস। আর একটা কাগজে কী একটু লিখে দিয়ে বলেছিল, এটা জোগাড় করতে পারলে খাস।