চাকরির অভাব অলকের নেই। রেল ডাকে, ব্যাংক ডাকে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ডাকে। বার দুই-তিন চাকরি বদলাল সে।
দিল্লির ট্রেন ধরবে বলে সকালে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট খেতে খেতে ডিম-ভরতি মুখে সত্যকাম মনীষাকে বলল, তোমার নাচের স্কুলে নতুন একটা মেয়ে ভরতি হয়েছে। সুছন্দা। এ ভেরি বিউটিফুল গার্ল। পারো তো ওকে অলকের সঙ্গে ভিড়িয়ে দাও।
মনীষা রীতিমতো ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, তার মানে?
লেট দেম মিক্স। তাতে ছেলেটার খানিকটা চোখ খুলবে, অভিজ্ঞতা হবে, তারপর যদি বিয়ে করতে চায় তো লেট দেম।
কী যে সব বলো না! ছেলে কি গিনিপিগ যে তার ওপর এক্সপেরিমেন্ট চালাবে! ওকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।
একটা লঙ্কাকুচি কামড়ে ঝালমুখে উঃ আঃ করতে করতে উঠে পড়ে সত্যকাম। কিন্তু দিল্লি পর্যন্ত আইডিয়াটা তার মাথায় থাকে। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সেও সে বেশ রোমান্টিক। এখনও সে টিন-এজারদের নিয়ে ভাবে। মেয়েদের সঙ্গে তার মেলামেশা ব্যাপক, গভীর এবং সংস্কারমুক্ত।
সত্যকাম দিল্লি চলে যাওয়ার পরদিনই নাচের ক্লাসে সুছন্দাকে একটু আলাদা করে লক্ষ করল মনীষা। মোটেই তেমন কিছু দেখতে নয়। খারাপও নয় তা বলে। কিন্তু আহামরিও বলা যায় না। মনীষা বারবারই সুছন্দার নাচের নানা ভুল ধরতে লাগল। দু-একবার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধমকও দিল।
ক্লাসের পর বাড়ি ফিরেই প্রিয়াঙ্গির ডাকনাম ধরে ডেকে বলল, এই ঝুমুর, অলক কোথায় রে?
দাদা! দাদা তো সকাল থেকেই বাড়িতে নেই।
কোথায় যায় রোজ এ সময়ে? আমার নাচ-গানের ক্লাসের কাছে গিয়ে ঘুরঘুর করে না তো?
তোমার নাচ-গানের ক্লাস! দাদা তো বোধহয় জানেই না তোমার নাচ-গানের ক্লাস কোথায়। কেন মা?
মনীষার মেজাজটা খারাপ ছিল। জবাব দিল না।
কথাটা অবশ্য মনে রাখল প্রিয়াঙ্গি। দুপুরে আবার সন্তর্পণে কথাটা তুলে জিজ্ঞেস করল, দাদাকে কি তোমার সন্দেহ হয়? দাদা সেরকম নয় কিন্তু।
মনীষা এর জবাবে বলল, সুছন্দাকে তো দেখেছিস! কেমন দেখতে বল তো!
কেন, বেশ তো।
কী জানি বাবা, আমিই বোধহয় কিছু বুঝি না।
কেন মা, কী হয়েছে? সুছন্দার সঙ্গে দাদার কি ভাব?
০২. চাঁপারহাটের দাসশৰ্মাদের বাড়ি
চাঁপারহাটের দাসশৰ্মাদের বাড়িতে বনানী নামে যে বামুনের মেয়েটা কাজ করে সে বামুন না বাগদি সে কথাটা বড় নয়। বড় প্রশ্ন হল মেয়েটা এখনও বেঁচে আছে কোনওরকমে।
বনানীর শোওয়ার জায়গাটা একটু অদ্ভুত। স্বাভাবিক খাট-বিছানা তাকে দেওয়া হয় না। সে শোয় লাকড়ি-ঘরের পাটাতনে। খানিকটা শুকনো খড় পুরু করে পেতে তার ওপর দুটো চট বিছিয়ে তার শয্যা। গায়ে দেওয়ার একটা তুলোর কম্বল আছে তার। আর একটা সস্তা নেটের ছেঁড়া মশারি। ফুটো আটকানোর জন্য নানা জায়গায় সুতো বাঁধা। গেরস্তর দোষ নেই। বনানী তেরো বছর বয়সেও বিছানায় মাঝে মাঝে পেচ্ছাপ করে ফেলে। নিজেই চট কাচে, খড় পালটায়। বড়ই রোগাভোগা সে। তেরো বছরের শরীর বলে মনেই হয় না। হাড় জিরজির করছে শরীরে। হাঁটুতে কনুইয়ে গোড়ালিতে কণ্ঠায় হনুতে হাড়গুলো চামড়া যেন ঠেলে বেরিয়ে আছে। মাথাটা তার প্রায় সর্বদাই ন্যাড়া। কানে দীর্ঘস্থায়ী ঘা। ঘা কনুইয়ে, মাথায়, হাঁটুতেও। বনানী ফরসা না শ্যামলা তা তাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। রোগা শরীরটায় একটা পাকাপাকি ধূসর বর্ণ বসে গেছে। তার মুখখানা কেমন তাও বলার উপায় নেই। হাড়ের ওপর চামড়ার একটা ঢাকনা, তাতে মনুষ্য অবয়ব আছে মাত্র।
দাসশৰ্মাদের প্রকাণ্ড সংসার। একশো বিঘের ওপর জমি। দুটো লাঙ্গল, একটা ট্রাক্টর। সারাদিন মুনিশ খাটছে, জন খাটছে, দাসদাসী খাটছে। বেহানবেলা কাক না ডাকতেই দাসশৰ্মাদের বাড়িতে শশারগোল পড়ে যায়। নিজের পাটাতনের বিছানায় শুয়েই বনানী শুনতে পায় উঠোনে গোরুর দুধ দোয়ানোর চ্যাং-ছ্যাং মিষ্টি শব্দ। সন্ধি ঝি উঠোন ঝাঁটাতে থাকে, পৈলেন বালতি বালতি জল ঢেলে গোহাল পরিষ্কার করে, ডিজেল পাম্প চালিয়ে গুরুপদ জল দেয় বাগানে। বশিষ্ঠ দাসশর্মা তারস্বরে তাণ্ডব স্তোত্র পাঠ করতে থাকে। ভোরবেলায় চারদিককার গাছগাছালিতে পাখিও ডাকে মেলা। উদুখলের শব্দ ওঠে। পৃথিবীর হৃৎপিন্ডের মতো চলতে থাকে টেকি। এ বাড়িতে কত কী হয়!
বনানীর বড় ভাল লাগে এই সংসারটা। কারণ এখানে বেশ পালিয়ে লুকিয়ে থাকা যায়। এত লোকজন চারদিকে যে, তার বড় একটা খোঁজখবর হয় না। প্রথম প্রথম সে রান্নাঘরে কাজ পেয়েছিল। কিন্তু গায়ে ঘা বলে সেখান থেকে তাকে সরানো হয়। এরপর বামুনের মেয়ে বলে তাকে দেওয়া হয় পুজোর ঘরে। কিন্তু বনমালী পুরুত ক্ষতযুক্ত মেয়ের হাতের জল বিগ্রহকে দিতে নারাজ। বনানীকে তাই সেখান থেকেও সরানো হল। এখন বলতে গেলে তার কোনও বাধা কাজ নেই। শুধু এর ওর তার ফাইফরমাশ খাটতে হয়। এই ফাইফরমাশের মধ্যে বেশিরভাগই মুদির দোকানে। যাওয়া।
বনানীর বাড়ি এই চাঁপারহাটেই। দাসশৰ্মাদের বাড়ি থেকে বেশিদুরও নয়। সেখানে তার বাবা আছে, মাসি আছে, মাসির দুটো মেয়ে আছে। মাসিকে মাসিও বলা যায়, মাও বলা যায়। তবে মা বলতে কখনও ইচ্ছে করে না বনানীর। তার নিজের মা মরার পর যখন বাবা মাসিকে বিয়ে করতে গিয়েছিল তখন বাবার কোলে চেপে সেও যায়। বাবার বিয়ে সে খুব অবাক হয়ে দেখেছিল। এমনকী সাত পাকের সময়েও সে বাবাকে ছাড়েনি, কোলে চেপে কাঁধে মাথা রেখে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে বাবার সঙ্গে মাসির শুভদৃষ্টি দেখেছিল। এখনও সব মনে আছে তার। দু’রকম মাছ, আমড়ার চাটনি আর দই খেয়েছিল খুব বাবার কোলে বসে। প্রথম প্রথম মাসি কি কম আদর করেছে তাকে? চান করাত, খাওয়াত, সাজাত। তারপর একদিন মাসির একটা মেয়ে হল। তারপর আর-একটা। তারপর কী যে হল তা বনানী ভাল বুঝতে পারে না। উঠতে বসতে বনানীর নামে বাবার কাছে নালিশ। তারপর মার শুরু হল। সঙ্গে গালিগালাজ। চান হয় না, খাওয়া হয় না, সাজগোজ চুলোয় গেল। বনানী কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যেতে লাগল দিন দিন। মাসি তাকে দেখলেই রেগে যায়। প্রথম-প্রথম তবু বাবা একটু আড়াল করত তাকে। পরে বাবাও গেল বিগড়ে। অত নালিশ শুনলে কার না মন বিষিয়ে যায়? বাড়ির অবস্থা আরও খারাপ হল যখন তার বাবার সঙ্গে মাসির ঘন ঘন ঝগড়া লাগতে লাগল। সে এমন ঝগড়া যে পারলে এ ওকে খুন করে। সেই সময় তার বাবা হাটে গিয়ে নেশা করে আসা শুরু করল। বাড়িটা হয়ে গেল কুরুক্ষেত্র। কত সময় সাঝঘুমোনি বনানী মারদাঙ্গার শব্দে সভয়ে উঠে বসে বোবা চোখে বাবা আর মাসির তুলকালাম কাণ্ড দেখেছে। মাসি। কতবার গেছে গলায় দড়ি দিতে, তার বাবা কতবার গেছে রেললাইনে মাথা দিতে। শেষ অবধি কেউ মরেনি। এসব যত বাড়ছিল মাসির রাগও তার ওপর তত চড়ে বসেছিল। প্রায় সময়েই বাবা বেরোনোর পর মাসি তাকে তুচ্ছ কারণে মারতে মারতে, লাথি দিতে দিতে ঘর থেকে বের করে দিত। সারাদিন বনানী বসে থাকত বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে। অভুক্ত, কখন বাবা আসবে সেই আশায় পথ চেয়ে থাকা। বাবা আসত ঠিকই, কিন্তু সেই বাবা যে আর নেই তা খুব টের পেত বনানী।