দুই বোনের মাঝখানে সে, অর্থাৎ অলক। বড় বোন অর্থাৎ দিদি মধুরা এবং বোন প্রিয়াঙ্গি যে যার স্বক্ষেত্রে সফল। বিশেষত মধুর ছিল যেমন ভাল ছাত্রী তেমনি সে গানে বাজনায় ওস্তাদ। এক চান্সে সে ডাক্তারি পাশ করে গেছে। প্রিয়াঙ্গি এখনও কলেজে, গানে বিশেষত রবীন্দ্রসংগীতে, সে ইতিমধ্যেই গুঞ্জন তুলেছে। একটি সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের তিনটি সন্তানের দু’টিবই এ রকম সাফল্য বেশ একটা বলার মতো ঘটনা। সেদিক দিয়ে তাদের বাবা সত্যকাম বন্দ্যোপাধ্যায় এবং মা মনীষা যথেষ্ট ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতী। মধ্যম সন্তানটি তাদের ডোবায়নি বটে, কিন্তু সে নিজেই এক সমস্যা। সত্যকাম এবং মনীষা দুজনেই কালচারের লাইনের লোক। দু’জনেরই গানের চর্চা ছিল, অভিনয়ের অভিজ্ঞতা ছিল। সত্যকাম একটা শৌখিন নাটকের দল চালিয়েছিল দীর্ঘকাল। মনীষ শান্তিনিকেতনে পড়ার সময় বহু নৃত্যনাট্য করেছে। এই পরিবারে একজন সাঁতারুর জন্মানোর কথা নয়। উপরন্তু যে। সাঁতারুর গানবাজনা ইত্যাদির প্রতি আকর্ষণ নেই। তবু মনের মতো না হওয়া সত্ত্বেও সত্যকাম এবং মনীষা ছেলেকে আকণ্ঠ ভালবাসার চেষ্টা করেছে। সত্যকাম জেনারেশন গ্যাপ তত্ত্বটা তত্ত্ব হিসেবে মানে বটে, কিন্তু তেমন বিশ্বাস করে না। তার ধারণা ছিল ছেলের বন্ধু হয়ে উঠতে তার আটকাবে না। সে নিজে মিশুক, উদার, অভিনয়পটু। সে নিশ্চয়ই পারবে। কিন্তু পারল না। অলকের চারদিকে যে একটা অদ্ভুত অদৃশ্য কঠিন খোল সেটাই তো ভাঙতে পারল না সে।
হতাশ হয়ে একদিন সে মনীষাকে বলেছিল, ইট ইজ নট জেনারেশন গ্যাপ।
তা হলে কী?
সামথিং মোর আরবান। ও বোধহয় কামুর সেই আউটসাইডার।
মনীষা ফোঁস কবে উঠে বলল, তুমি ছাই বোঝো। আমার ছেলেকে আমি বুঝি। কথাটা মিথ্যে নয়। মনীষা খানিকটা বোঝে। আর বোঝে বলেই তেমন ঘটায় না। আবার মনীষা অলকের অনেকটাই, বেশিরভাগটাই বোঝে না। এই না-বোঝা অংশটা তার অহংকে অহরহ নিষ্পেষিত করে। মা হয়ে ছেলেকে বুঝতে না পারার মতো আর কষ্ট কী আছে?
সত্যকাম দু’বার দুটো সিনেমা ম্যাগাজিন বের করেছিল। ফিল্মে সে বেশ কিছুদিন এক বিখ্যাত পরিচালকের সহকারী থেকেছে। একাধিক বৃহৎ ফাংশনের ইমপ্রেশারিও হয়েছে। এখন সে একটি ইংরিজি দৈনিক পত্রিকার ফিল্ম সেকশনে চাকরি করে। মাইনে যথেষ্ট ভাল, কিন্তু সত্যকাম এটুকুতে খুশি নয়। আরও অনেক বড় হওয়ার কথা ছিল তার, এবং স্বাধীন। সুতরাং এখনও সে হাল ছাড়েনি। মাঝে-মধ্যেই শর্ট ফিল্ম তোলে, ফিচার ফিল্মের স্ক্রিপ্ট করে এন এফ ডি সি-তে ধরনা দেয় এবং প্রযোজক খুঁজে বেড়ায়। টুকটাক দুটো-একটা ছবি সে মাঝে-মধ্যে তুলেও ফেলে। কোনওটাই বাজার তেমন গরম করে না। কিন্তু এসব নিয়ে এবং দিল্লি বোম্বাই করে সত্যকাম খুবই ব্যস্ত থাকে। একটা কিছু করছে, থেমে যাচ্ছে না, এই বোধটাই তার কাছে এখন অনেক। বয়স চল্লিশের কোঠায়, পঞ্চাশের মোহনায়। এখনও বাড়ি হয়নি, গাড়ি নেই, বড় মেয়ের বিয়ের খরচের কথা সব সময়ে মনে রাখতে হয়।
মনীষার উচ্চাকাঙ্ক্ষা রেডিয়ো এবং টেলিভিশনে প্রোগ্রাম পাওয়া পর্যন্ত থমকে গেছে। মাঝে-মধ্যে গায়। একটা-দুটো রেকর্ড হয়েছিল একদা। মাঝে-মধ্যে ফাংশনে গাইবার ডাক পায়। তবে মনীষার একটা বেশ রমরমে নাচগানের স্কুল আছে। তা থেকে আয় মন্দ হয় না। আয়ের চেয়েও বড় কথা, মেতে থাকা যায়। একটা কিছু করছে, কাউকে কিছু শেখাচ্ছে, এটাও বা কম বোধ কিসের? চল্লিশ সেও পেরিয়েছে। আজকাল অবশ্য এটা তেমন কোনও বয়স নয়। কিন্তু মনীষা আর তেমন কোনও উচ্চাশার হাত ধরে হাঁটে না। তার উচ্চাশা গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়েছে দুটো মেয়ে ওপর। মধুরা আর প্রিয়াঙ্গি যদি কিছু করতে পারে তবেই হল। মনীষা এটাও বোবে মিডিয়োকারদের যুগ এটা নয়। মাঝারিরা চিরকাল মাঝবরাবর মধ্যবিত্ত থেকে যায়, কী প্রতিভায়,
কী সাফল্যে। মধুরা মাঝারির চেয়ে অনেকটা উঁচুতে, প্রিয়াঙ্গি অনেকটাই মাঝারি।
অলক কেমন? না, তা মনীষা বা সত্যকাম জানে না। তারা অলকের আনা কাপ-মেডেলগুলো খুব যত্ন করে সাজিয়ে রাখে। দুঃখের খিষয় সত্যকাম সাঁতার জানেই না, মনীষা একটু-আধটু জানে না-জানার মতোই। ছেলে সম্পর্কে সত্যকাম একবার বলেছিল, ও যদি সাঁতারই শিখতে চায় তে. বহোত আচ্ছা। চলে যাক পাতিয়ালা বা এনিহোয়ার, ভাল কোচিং নিক, লেট হিম গো টু এশিয়াড অর ইভন অলিম্পিক।
মনীষা বাধা দিয়ে বলেছিল, ওসব ওকে বলতে যেয়ো না। আমি যতদূর জানি ও সাঁতার দিয়ে নাম করতে চায় না। প্লিজ, ওকে ওর মতো হতে দাও।
সত্যকাম বুদ্ধিমান। ছেলে আর তার মধ্যে জেনারেশন বা অন্য কোনও গ্যাপ যে একটা আছে, তা সে জানে। তাই সে চাপাচাপি করল না। শুধু চাপা রাগে গনগন করতে করতে বলল, সাঁতার তো খারাপ কিছু নয়। আমি বলছি–
প্লিজ, কিছু বলতে হবে না। লেট হিম বি অ্যালোন।
লেখাপড়ায় অলকের তেমন ভাল হওয়ার কথা নয়। সারা বছর নানা কমপিটিশনে যেতে হলে পড়াশুনো হয়ও না তেমন। কিন্তু বেহালার যে স্কুলে সে পড়েছে বরাবর সেই স্কুলের মাস্টারমশাইরা দেখে অবাক হয়েছেন যে, এক-একবার এক-এক বিষয়ে অলক সাংঘাতিক নম্বর পায়। কোনওবার ইতিহাসে শতকরা আশি, কখনও অঙ্কে নব্বই, কখনও বাংলায় পঁচাত্তর বা ইংরিজিতে সত্তর। অর্থাৎ কোন বিষয়ের প্রতি যে তার পক্ষপাত সেটা বোঝার উপায় নেই। টেস্টের পর মাস্টারমশাইরা একটা কোচিং খুলে তাতে অলককে ভরতি করে নেন এবং এই বিখ্যাত সাঁতারু ছেলেটিকে যত্ন করে তৈরি করে দেন। তারই ফলে অলক হায়ার সেকেন্ডারি ডিঙোয় ফাস্ট ডিভিশনে। টায়ে-টায়ে। ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর ইচ্ছে ছিল সত্যকামের। অলক রাজি হয়নি। সে গেল নেভিতে ভরতি হতে। হল, কিন্তু ছ’ মাস পর ফিরে এসে বলল, ভাল লাগল না। পরের বছর বি এ ক্লাসে ভরতি হল। সাদামাটাভাবে পাশ করে গেল।