সে স্মিত মুখে বলল, ভয় নেই। আমাকে ভয় পেয়ো না। যাচ্ছি।
মেয়েটা জবাব দিল না।
কিট ব্যাগ কাঁধে অলক ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাচ্ছিল। শেষ ধাপে পা রাখল।
হঠাৎ ওপর থেকে প্রশ্ন এল, তুমি কোথায় যাচ্ছো?
অলক মুখ তুলল। মেয়েটা সিঁড়ির রেলিং-এ ঝুঁকে চেয়ে আছে তার দিকে।
যাচ্ছি কোথাও। কেন?
তুমি আর আসবে না?
অলক অবাক হল। মেয়েটা কি কিছু টের পেয়েছে? পাওয়ার কথাই তো নয়। সৌরীন্দ্রমোহন হয়তো পেয়েছিলেন। আটিস্টের চোখ তো। কিন্তু স্পষ্ট করে ধরতে পারেননি। এ মেয়েটা কি পেল?
না, সেটা সম্ভব নয়। তাই মেয়েটার দিকে চেয়ে অলকের হঠাৎ সত্যি কথাটাই বলতে ইচ্ছে হল। বললে ক্ষতি কী?
না, আর আসব না।
মেয়েটা অস্ফুট একটা আর্তনাদ করে উঠল। মুখটা সরে গেল আড়ালে।
অলক ভীষণ অবাক হল। আর্তনাদ করল কেন? অলক আসবে না, তাতে ওর ক্ষতি কী?
কয়েক মুহূর্ত দ্বিধাভরে সঁড়িয়ে থেকে অলক সদরের দিকে এগোয়।
একটু দাঁড়াও।
সবিস্ময়ে ফিরে তাকায় অলক।
মেয়েটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে।
কৌতুকের হাসি মুখে নিয়ে অলক বলল, কী চাও?
প্রায় দৌড়ে নেমে এসেছে বলে মেয়েটা হাঁফাচ্ছে। বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছো? জলে? আমাকে সঙ্গে নেবে? নাও না!
অলক হাঁ করে চেয়ে রইল ওর মুখের দিকে, আমার সঙ্গে কোথায় যাবে?
জলে। আমিও তো মরতেই চাই। অনেক পাপ হল যে!
মরবে! মরবে কেন?
আমার তো মরতেই জন্ম।
কে বলল ও কথা?
আমি জানি। আমার বাবাও বলত, তুই তো মরতেই জন্মেছিস।
অলক খানকক্ষণ বিস্ময়ে চুপ করে থাকে। তারপর বলে, আমি আর আসব না এ কথা তোমাকে কে বলল?
জানি যে। তোমার চোখ দেখে, মুখ দেখে টের পাইনি বুঝি?
তোমার পাপ হয়েছিল? কিসের পাপ?
ভীষণ পাপ। তোমার দিকে তাকাতুম যে! পিনি বারণ করেছিল।
অলক এত হেসে উঠল যেমনটি সে জীবনেও হাসেনি। তারপর সামলে গিয়ে বলল, মরার খুব জরুরি দরকার বুঝি?
মেয়েটা অলকের মুখের দিকে তেমনি ডাগর দুই চোখে নিষ্কম্প তাকিয়ে ছিল। বলল, শুধু বেঁচে থাকতেই যে কত কষ্ট। তুমি তো জানো না, দুটো ভাত, মাথার ওপর একটু চালা, এটুকুও জোটে যে কিছুতেই। এর বাড়ি থেকে তাড়ায়, ওর বাড়ি থেকে তাড়ায়। কবেই মরতুম গলায় দড়ি দিয়ে।
তা সেটা করোনি কেন?
একদিন স্টেশনে বটকেষ্টকে দেখলুম যে। চোখ নেই, নাক নেই, হাত নেই, পা নেই, শুধু মুখ আর নাকের জায়গায় দুটো ফুটো। ও কি মানুষ? একটা মাংসের ঢেলা। তবু বেঁচে আছে তো? ভয় হল, বাঁচা কত শক্ত। শুধু বেঁচে থাকাই কত শক্ত। ইচ্ছে যায় না বলো বেঁচে থাকতে? বটকেষ্টরও যদি ইচ্ছে যায় তো আমার দোষ কী?
তবে মরতে চাও কেন?
তুমি যে আর আসবে না। তুমি না এলে কী হবে জানো?
কী হবে?
আবার রোগা ল্যাকপ্যাকে হয়ে যাব আমি। শরীরে ঘা বেরোবে। কত কী হবে। তুমি এলে বলেই তো আমি সেরে গেলুম।
অলক এ যেন এক রূপকথার গল্প শুনছে। এরকম কেউ তাকে কখনও বলেনি তো! অলকের চোখ জ্বলতে লাগল। খাস গাঢ় হল।
মেয়েটার চোখে স্বপ্নাতুর এক বিভোর দৃষ্টি। সম্মোহিতের মতো। প্রগাঢ় এক স্বরে বলল, তাই ভাবলুম, ও তো চলে যাচ্ছে। এবার তো আমি মরবই। তা হলে ওর সঙ্গে যাই না কেন?
বুক মথিত করে একটা শাস বেবিয়ে এল অলকের। দীর্ঘ এক সাঁতার অপেক্ষা করছে তার জন্য। অপেক্ষা করছে নদী, মোহনা, সমুদ্র। তারপর জলই টেনে নেবে তাকে, জলে মিশে যাবে সে, যেমন চিনি মিশে যায়। তবে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে জল। সে মেয়েটার দিকে চেয়ে আরও কিছু আবিষ্কার করে নিচ্ছিল।
খুব কষ্ট পেয়েছ তুমি?
মেয়েটা একটু হাসল, কী যে কষ্ট! তবু কী জানো? শুধু বেঁচে থাকাটাও কিন্তু ভীষণ ভাল। শুধু যদি বেঁচে থাকা যায় তাহলেও কত কী হয়! মরব মরব করেও আমার যে বেঁচে থাকতে কী ভালই লেগেছে কটা দিন। উফ, কোনওরকমে বেঁচেছিলুম বলেই না একদিন হঠাৎ তোমার দেখা পেলুম। কত কী হয়ে গেল! তুমি ঠিক যেন ভগবান।
অলক চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। ভারী অন্যমনস্ক, চিন্তিত।
যাবে না?
ভারতবিখ্যাত সাঁতারু আজ জীবনে প্রথম অনুভব করল, ডাঙায় যেন প্লাবনের মতো জলের ঢল নেমে এসেছে। ফোম রবারের চেয়েও নরম, সফেন, ঠান্ডা জল তাকে আকণ্ঠ ঘিরে ধরল আজ।
বনানী বলল, যাবে না?
সাঁতারু ডাঙার প্লাবনে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মৃদু হেসে বলল, যেতে দিলে কই?