তিন দিন বাদে মনীষা একদিন চড়াও হয় অলকের ওপর, তুই ভেবেছিসটা কী?
কী ভাবব?
তোর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে তা জানিস?
না।
সুছন্দার সঙ্গে।
কথাটা বলে কিছুক্ষণ অপলক চোখে চেয়ে ছেলের মুখে একটা প্রতিক্রিয়া খুঁজল। সম্পূর্ণ ভাবলেশহীন মুখ, শূন্য ও অকপট চোখ, সুখ দুঃখ কিছুই খেলা করে না ওর মুখে। ওর বাবা বলে, গাছ। তাই হবে। আগের জন্মে বোধহয় গাছই ছিল।
একা একা ফিরে গিয়ে মনীষা একা একা কাঁদতে বসে। সে জানে, সত্যকাম কী চায়। বোকা নির্বোধ ছেলেটা টেরও পাবে না তার আড়ালে ওই শয়তান সত্যকাম আর শয়তানি সুছন্দা কী লীলা করে যাবে। যে-কোনও ছুতোয় ঘরে ওই অলক্ষ্মীকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে সত্যকাম। মনীষা শুনেছে, সুছন্দাও অলকের পিছু পিছু ঘুরঘুর করে। মনীষা কিছুতেই ঠেকাতে পারবে না ঘটনাটা। ঘটে যাবে। যদি তার নিজের নৈতিক জোর থাকত তা হলে পারত আটকাতে। চতুরলালের ঘটনাটা তো আর মিথ্যে নয়। মস্ত ইমপ্রেসারিও। মনীষাকে সে-ই ইনডোর স্টেডিয়ামের বিশাল ফাংশনে চান্স করে দিয়েছিল। লতা, আশার মতো গায়িকাদের সঙ্গে এক সারিতে তো বসতে পেরেছিল সে। তার জন্য একটু দাম দিতে হবে না? সত্যি বটে, ঝুমুরের সঙ্গে লটকে না পড়লেও পারত চতুর। কিন্তু পড়লেই বা দোষটা কী এমন হয়েছে? চতুরের কত কানেকশন, কত বড় বড় ফাংশন অর্গানাইজ করে। ঝুমুরটাকে ঠিক তুলে দেবে ওপরে।
সেই একটুকু অপরাধের এই শাস্তি। এই প্রায়শ্চিত্ত।
একা একা মনীষা অনেক কাঁদল। এই যে বহু-ব্যবহৃত শরীর, যৌবন যায়-যায়, এর কি তেমন কোনও আলাদা শুদ্ধতা আছে? ক’দিন আর? দশ-বিশ বা পঁচিশ-ত্রিশ বছর পর একদিন ধুকধুকুনি থামবে। কিছু লোক কাঁধে নিয়ে গিয়ে কেওড়াতলায় জ্বালিয়ে দিয়ে আসবে। কী দাম এর?
ডাঙায় বড় ক্লান্তি বেড়ে যায় অলকের। আজকাল তার কেবলই মনে হয়, এক অনন্ত জলাশয় তার। দরকার। দরকার নিরেট নির্জনতা। ফোম রবারের চেয়েও নরম ঠান্ডা জলে অন্তহীন এক সাঁতার। একদিন ধীরে ধীরে ক্লান্ত অলককে জলই মিশিয়ে নেবে নিজের বুকে। জলে মিশে যাওয়া ছাড়া আর কী করার আছে তার? সে নিজেই এক শান্ত জলাশয়ের মতো নিস্তরঙ্গ, শীতল। সে রাগে না, উত্তেজিত হয় না।
না, হয়েছিল। জীবনে মাত্র একবার। বোধহয় মাত্র ওই একবারই। দাদুর বাড়ির ছাদে সেদিন আচমকা উঠে গিয়ে মেয়েটাকে মুখোমুখি পেয়ে যায় সে। কেন যে সেদিন তার ওই রাক্ষুসে রাগ ঝড় তুলল বুকে!
দোষ নেই অলকের। ওকে যে বহুবার দেখেছে অলক জলে ভেসে থাকতে। ভোরের সুন্দরবনে, গোপালপুরের সমুদ্রে, শেষ রাতে লেক-এর কুয়াশামাখা নীল জলে। জলকন্যা কেন উঠে আসবে ডাঙায়? কেন সে পরের উচ্ছিষ্ট খাবে? কেন হবে পরামভোজী? কেন সে চুল শুকোবে রোদে বসে? এইসব প্রশ্নই সে করতে চেয়েছিল। জানতে চেয়েছিল, তুমি কে? তুমি আসলে কে?
মেয়েটা কেন যে অমন ভয় পেয়ে গেল। বুঝতেই পারল না অলক কী বলতে চায়। এক বোবা ভয়ে রেলিং টপকে…
সেই ঘটনার বহুদিন বাদে আজ দাদুর বাড়িতে এল অলক।
প্রথমে টের পেল ঠাকুমা। ঠাকুমাই তাকে বরাবর সবচেয়ে ভাল টের পায়। বনলতা বললেন, অত রোগা হয়ে গেছিস কেন? চোখের কোল বসে গেছে! রাতে ঘুম হয়?
অলক হাসল। তারপর বলল, এবার এক লম্বা সাতারে যাচ্ছি, বুঝলে?
কত লম্বা? ক’মাইল?
ঠিক নেই।
তার মানে?
এখনও ঠিক হয়নি কিছু। তবে পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা সাঁতার।
পারবি? দরকার নেই।
দেখা যাক না। মানুষ তো সব পারে।
বেলা এগারোটার রোদে বারান্দায় বসে সৌরীন্দ্রমোহন কোলে প্যাড আর স্কেচ–পেনসিল নিয়ে বসেছিলেন। সামান্য রেখায় একটি-দুটি ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন আনমনে।
অলককে দেখে বললেন, বোস তো ওই মোড়াটায়। তার একটা স্কেচ করি।
একটু সময় নিলেন সৌরীন্দ্রমোহন। কিন্তু ফুটিয়ে তুললেন অসাধারণ। অলকের শূন্য চোখ, শীর্ণ হয়ে আসা মুখ, চোখের নীচে বসা—সব এল ছবিতে।
মাথা নেড়ে সৌরীন্দ্রমোহন বললেন, না, তোর চেহারাটা ঠিক এরকম নয়।
অলক হাত বাড়িয়ে প্যাডটা নিয়ে দেখল। বলল, এরকমই। এই তো আমার হুবহু মুখ।
একটা সিকনেস ফুটে উঠেছে না ছবিতে? তুই তো হান্ড্রেড পারসেন্ট ফিট।
ছবিটায় কোনও ভুল নেই, দাদু।
সৌরীন্দ্রমোহন তবু সন্দিগ্ধভাবে ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। অলকের মুখটা ফের দেখলেন ভাল করে। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, স্টিল সামথিং ইজ রং। ভেরি মাচ রং। একটা কিসের যেন ছায়া পড়েছে তোর মুখে। এরকম তো নয় তোর মুখ! এবম তো হওয়ার কথা নয়!
সংশয়টা বাড়তে দিল না অলক। উঠে এল বারান্দা থেকে।
সিঁড়ির দিকে মুখ করে দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেয়েটা দাঁড়ানো। মুখে সেই বোবা ভাব, চোখ-ভরা ভয়। আজ পালাল না। চেয়ে রইল। অলক নিজে প্রায় বোবা। এ মেয়েটা কি তার চেয়েও বোবা?
কে জানে কেন মেয়েটার সঙ্গে আজ একটু খুনসুটি করতে ইচ্ছে হল অলকের। এমন ইচ্ছে তার কোনওদিন হয়নি। ইচ্ছেটা হল বলে ভারী অবাকও হল অলক। একটু হাসল সে।
কী খুকি, আজ যে বড় পড়লে না? আমি এলেই তো তুমি হয় সিঁড়ি থেকে, না হয় ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার চেষ্টা করো। আজ কী হল?
মেয়েটা জবাব দিল না। মুখটা সামান্য ফাঁক, ঘন শ্বাস পড়ছে, চোখদুটো স্থির, অপলক।
আবার একটু হাসল অলক। বড় সুন্দর মেয়েটা। জলকন্যা বলে মনে হয়েছিল অলকের। সেই দুপুরে যখন ছাদ থেকে রেলিং টপকে পড়ে যাচ্ছিল তখনই বিভ্রম ভেঙে অলক বিদ্যুতের গতিতে গিয়ে ওকে প্রায় শূন্য থেকে চয়ন করে আনে। আর ভুল করবে না অলক।