ভয় হল, যখন জল থেকে ডাঙায় উঠল, তখন। অত কাছাকাছি কিছুক্ষণ দুটো মারাত্মক বিষধর সাপ তার সঙ্গে সাঁতার দিয়েছে সে কথা ভেবে গা শিউরে উঠেছিল তার। জলে অলক অন্যরকম। জলের অলক আর ডাঙার অলক যেন দুটো মানুষ।
আজ হেমন্তের সকালে চিত হয়ে স্থির হয়ে জলে ভেসে আকাশের দিকে চেয়ে অলক দু’রকম নিজের কথা ভাবল। ভাবল দুটো সাপের কথা। তারপর ভাবনা মুছে গেল মাথা থেকে।
মাঝে মাঝে তার সব ঘুমিয়ে পড়ে। মাথা ঘুমোয়, মন ঘুমোয়, দৃষ্টিশক্তি ঘুমোয়।
মা গো!
একটা অদ্ভুত করুণ টানা বাঁশির সুরের আর্তনাদ শুনে ঘুম ভাঙল অলকের। সে সচকিত হতে গিয়েও হেসে ফেলল।
মেয়েটা কি পাগল? রেলিং-এর ওপর যেন ভেজা কাপড়ের মতো নেতিয়ে পড়ল। তারপর… মা গো-ও-ও…! সেই আর্তনাদ কখনও ভুলবে না অলক।
আলো ফুটেছে। অলক ধীরে ধীরে পাড়ে এসে উঠল।
ক্লাবের বারান্দায় আজও বসে আছে সুছন্দা। প্রায়ই থাকে।
অলক গা মুছে পোশাক পরে এসে মুখোমুখি বসল।
সুছন্দা আজও চোখের দিকে তাকাতে পারে না তার। টেবিলে আঁকিবুকি কাটে আঙুল দিয়ে।
অলক!
বলো।
কী ঠিক করলে?
কিছু না।
আমাকে আর কত নির্লজ্জ হতে বলবে তুমি? বিয়ের পর আমি তোমার সঙ্গে যে-কোনও জায়গায় চলে যেতে রাজি আছি। কথা দিচ্ছি কখনও আর সিনেমায় নামব না। সব ছাড়ব, সব ভুলে যাব।
ডাঙা। ডাঙায় উঠলেই যত জটিলতা, যত কিছু যন্ত্রণা। অলক চুপচাপ বসে রইল সুছন্দার দিকে স্থির চোখে চেয়ে।
সুছন্দার চোখ দিয়ে আজও টস টস করে জল পড়ছিল। মাথা নিচু করে সে বলল, যা হয়ে গেছে তা কি খুব সাংঘাতিক কিছু অলক? ওরকম তো কতই হয়। তোমারও কি হয়নি কোনও মেয়ের সঙ্গে? ভেবে দেখো। সে মেয়ে কি তবে নষ্ট হয়ে গেছে?
অলক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বলল, চলো, তোমাকে পৌঁছে দিয়ে যাই।
কিছু বলবে না? ভিতরে ভিতরে আমি যে শেষ হয়ে আসছি। এই টেনশন কতদিন সইতে পারব আমি?
স্কুটারে তার পিছনে বসে সুছন্দা খুব নিবিড় করে বেষ্টন করল তাকে।
অলক! প্লিজ, অলক!
বাতাসে আর স্কুটারের শব্দে কথাগুলো উড়ে গেল। অলক শুনল না। বা শুনলেও গা করল।…
সত্যকাম আজকাল সকালের দিকেই যা খানিকক্ষণ বাড়িতে থাকে। তারপর বোধহয় বেরিয়ে যায়। রাত্রে মাতাল হয়ে ফেরে, ফিরে আরও মাতাল হয়। সকালে যতক্ষণ বাড়িতে থাকে ততক্ষণ মনীষার সঙ্গে তার ঝগড়া হয়। সে ঝগড়া এমনই বে-আব্রু, এমনই নির্লজ্জ যে মনে হয় দু’জনেই একটা শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।
আর এগোনোর রাস্তা নেই তাদের। একটা নিরেট দেয়ালে ঠেকে গিয়ে তারা অক্ষম মাথা কুটে মরে।
সুছন্দাকে পৌঁছে যখন বাড়ি ফিরল অলক তখন মনীষা আর সত্যকাম রোজকার মতোই ঝগড়া করছে। চেঁচিয়ে নয়, তবে বেশ উঁচু গলায়। সত্যকাম ডিমের পোচ টোস্টে বিছিয়ে নিয়ে খেতে খেতে এবং মনীষা চা করতে করতে।
সত্যকাম বলছে, কেন? তোমার ছেলে সুছন্দাকে বিয়ে করবে না কেন? শি ইজ কোয়াইট অলরাইট। বিউটিফুল, কোয়ায়েট, কোয়ালিফায়েড। এর চেয়ে বেশি কী আশা করো তুমি?
কোন মুখে বলছ ওসব কথা? তোমার লজ্জা করে না? ওই প্রসটার সঙ্গে অলকের বিয়ে দেব আমি? তুমি ভেবেছটা কী?
ওসব আনডিগনিফায়েড টার্ম ব্যবহার করছ, তোমারই লজ্জা করা উচিত। আজকাল ক’টা মেয়ে ইনোসেন্ট আছে বলতে পারো? আর ইউ ইওরসেলফ ইনোসেন্ট? তোমার দুটো মেয়ের একটাও কি বিয়ের আগে ইনোসেন্ট ছিল? আর তোমার ওই গাছের মতো আকাট ছেলে, তার খবরই বা তুমি কতটুকু রাখো? ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে, বুঝলে?
ইনোসেন্ট নয় সে এক কথা, কিন্তু সুছন্দা ইজ ইনভলভড উইথ ইউ। ইভন ইউ স্লিপ উইথ হার।
ঝগড়ার সময় অশ্লীল ইঙ্গিতগুলি দু’জনেই ইংরিজি ভাষায় করে। এটা রোজই লক্ষ করছে অলক।
সত্যকাম গলা তুলে বলল, নেভার। কোন শালা ওকথা বলে? আই ট্রিট হার অ্যাজ মাই… মাই..
থাক, আর সাধু সেজো না। কিছুই আমার অজানা নেই।
সত্যকাম ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলে, আর চতুরলালের সঙ্গে ঝুমুরের বিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে অত চুলকুনি কেন তোমার সে কি আমি জানি না ভেবেছ? ঝুমুরের চেয়ে ও বিশ বছরের বড়। বাট ইউ জাম্পড অ্যাট দা প্রোপোজাল। চতুরের গাড়িতে করে তুমি কোথায় কোথায় যেতে তার একখানা লগবুক আমার আছে। বেশি সাধ্বী সেজো না।
মনীষার ফেঁপানির শব্দ ওঠে, প্রতিবাদের নয়।
এই সকালে দুটো বিষধর সাপ পরস্পরের ওপর তাদের সমস্ত বিষ উজাড় করে নিঃস্ব হয়। সারা দিন ধরে আবার জমিয়ে তোলে বিষ, আবার ওগড়াবে বলে। একই পদ্ধতি।
অলক টের পায়, ওদের আর এগোবার রাস্তা নেই। দেয়ালে ঠেকে গেছে।
হেঁচকি-তোলা ধরা গলায় মনীষা বলে, এত মেয়ে থাকতে সুছন্দাকেই কেন অলকের বউ করতে চাও?
আই অ্যাম গোয়িং টু মেক হার এ বিগ স্টার। কিন্তু মেয়েটা বড্ড বেশি চঞ্চল। এর-ওর দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আজেবাজে প্রোডিউসারের পাল্লায় পড়ে যাচ্ছে। নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওর কেরিয়ার। অথচ শি ইজ ভেরি প্রমিজিং। একটা জায়গায় স্থির না হলে ওর কেরিয়ার তৈরি হবে না। তোমার ওই হাঁ-করা বোকা ছেলেটাকে বোধহয় ও ভালবাসে। বিয়ে হলে আমার দুদিকেই সুবিধে। ওকে তৈরি করতে পারব, তোমার ছেলেরও হিল্লে হবে। ইট ইজ নট এ ব্যাড প্রোপোজাল।
অবশেষে মনীষা চুপ করে। সত্যকাম চা খায় এবং হাসিমুখে বেরিয়ে যায়। সে জিতে গেছে।
আজ বহুকাল বাদে পক প্রণালীর সেই দুটো প্রকাণ্ড সাপের কথা ভেবে অলক শিউরে ওঠে ভয়ে। গা ঘেঁষে দু’দিকে তার সমান্তরাল সাঁতরে চলেছে দুটো ভয়ংকর বিষধর।