ভাবতে ভাবতেই আবার বুক ঢিবঢিবিয়ে উঠল তার। মাথা নেড়ে আপনমনে বলল, থাক বাবা। না এসে ভালই হয়েছে। ও এসে সামনে দাঁড়ালে আমার ঠিক হার্টফেল হবে।
শরীরের ব্যথা তেমন সত্যিই টের পাচ্ছিল না বনানী। অলক ঘণ্টা দুয়েক থেকে চলে গেল। বিকেল হল। সন্ধের মুখে বনানীর কনুই নীল হয়ে ফুলে উঠল। হাঁটু আর গোড়ালিতেও তাই। অসহ্য টাটানি।
সৌরীন্দ্রমোহন এলেন, বনলতা এলেন, এল সোনালিও।
বনানী কাতর স্বরে বলল, তোমরা যাও না! আমার কিছু হয়নি।
সোনালি কঠিন গলায় বলল, সেটা আমরা বুঝব। চুপ।
ডাক্তার শুভ্র দাস এসে বনানীকে দেখল। প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে বলল, হ্যাঁ রে বনা, যে মেয়েটাকে বর্ধমানের গা থেকে তুলে এনেছিলাম তুই ঠিক সেই মেয়েটাই তো? তোকে যত দেখি তত আমার অবিশ্বাস হয়। তোর বাবা যদি দেখে তো মুছা যাবে।
সবাই আজকাল এরকম সব কথা বলে,বনানীকে। বনানীর সুখ না দুঃখ হয় তা বলতে পারবে না সে। তবে ভারী অস্থির, উত্তেজিত বোধ করে সে।
রাত্রিবেলা ব্যথায় মলম মালিশ করতে এল সোনালি। আঁতকে উঠে বসল বনানী, তুমি কেন? মালিশ আমিই করতে পারব। দাও আমাকে।
সোনালি ধমক দিয়ে বলল, খুব হয়েছে। কনুই ফুলে ঢোল, ওই হাতে উনি মালিশ করবেন!
তা বলে ঝিয়ের পায়ে হাত দেবে? পাপ হবে না আমার?
ঝি! ঝি কোন দুঃখে হতে যাবি? তোকে আমি পুষ্যি নিয়েছি মনে মনে। আজ রাতে আমার সঙ্গে শুবি।
ও মাগো! পারব না। পায়ে পড়ি।
এই কমপ্লেক্স কেন তোর? তোকে তো আমরা ছোট ভাবি না, তবে তুই কেন ভেবে মরিস? রাত্রে ব্যথা বাড়লে কে দেখবে তোকে?
লজ্জায় মরে গেল বনানী। আর মনে মনে বলল, হে ভগবান, এই বাড়ি থেকে যেন আমাকে কখনও তাড়িয়ে না। এরা বড় ভাল।
তিন-চারদিন পর দুপুরের খাওয়া হয়ে গেলে বনানী চুল শুকোতে গেল ছাদে। রোদুরে পিঠ আর চিলেকোঠার ছায়ায় মুখ রেখে কোলে বই নিয়ে বসে পড়া তার খুব প্রিয়। মাঝে মাঝে চোখ তুলে আকাশের দিকে তাকায়। আকাশে হেমন্তের খণ্ড-মেঘ ভেসে ভেসে যায়, চিল ওড়ে, চিলেকোঠার ছাদে বসে কাক ডাকাডাকি করে। ভারী শান্তি পায় সে মনে।
বনানী হঠাৎ শুনতে পেল সিঁড়ি দিয়ে একজোড়া পায়ের শব্দ উঠে আসছে।
চকিত হল সে। বাড়িতে তারা সাকুল্যে তিনটি প্রাণী এই নির্জন দুপুরে। ছাদে তবে কে আসবে?
সতর্ক হওয়ার বা নিজেকে লুকিয়ে ফেলার সময় পেল না বনানী। হঠাৎ ছাদে এসে দাঁড়াল দীর্ঘ, ছিপছিপে সেই সাঁতারু। একদম মুখোমুখি। সোজা তার চোখে চোখ। ভয়ে বনানী উঠে দাঁড়িয়ে শিউরে কয়েক পা পিছিয়ে গেল।
বনানী নিশ্চল হয়ে গেল। কিন্তু ভিতরে সেই ঝড়, ভূমিকম্প, বজ্রপাত। চোখ আঠাকাঠিতে আটকানো পাখির মতো লেগে আছে ছেলেটার চোখে।
হঠাৎ ছেলেটা আশ্চর্য এক প্রশ্ন করল, তুমি কে বলল তো?
বনানী জবাব দেওয়ার জন্য নয়, আর্তনাদ করার জন্য হাঁ করেছিল। কিন্তু কোনও শব্দ হল না। বুকে হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে পড়ে যেতে চাইছে ভয়ংকর দোলায়। মাথার মধ্যে অদ্ভুত রেলগাড়ির ঝিক ঝিক শব্দ হচ্ছে।
ছেলেটা তাকিয়ে আছে। স্থির শূন্য একরকম পাগলাটে দৃষ্টি। ফের বলল, কে তুমি? কোখেকে এলে? কেন?
বনানীর চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হল, আমি কেউ না। আমি নেই। আমি কখনও জন্মাইনি। আমাকে ছেড়ে দিন।
পারল না। গলা দিয়ে একটা শব্দও বেরোল না। ছাদের রেলিং-এ ঠেস দিয়ে সে শুধু বোবা চোখে চেয়ে রইল ছেলেটার দিকে।
বললে না তুমি কে? কী চাও?
বনানীর বুকে কথার বুদবুদ ভেসে ওঠে, আমি! আমি কিছুই চাই না। শুধু দুবেলা দুমুঠো ভাত, মাথার ওপর একটু ঢাকনা…
ছেলেটা এগিয়ে এল কাছে। বনানী উভ্রান্ত, সন্ত্রস্ত, বোবা। তবু লক্ষ করল, ছেলেটার মাথা উস্কোখুস্কো, চোখ দুটো লাল, মুখখানায় শুকনো ভাব।
ছেলেটা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, বলবে না?
বনানী বলল, অনেক কথা বলল সে। কিন্তু কোনও কথাই মুখে এল না। অনুচ্চারিত সেই সব কথা তার বুকে ঘুরতে লাগল অন্ধের মতো। সে বলল, বলছি তো, শুনতে পাচ্ছেন না কেন? আমার গায়ে ঘা ছিল, ন্যাড়া মাথা, লোেগাও ছিলুম বড়, বিছানায় পেচ্ছাপ করতুম। চাঁপারহাটের চাটুজ্যেদের মেয়ে আমি। বাবা খুব ভালবাসত আমায়। তার কোলে চেপে বিয়েতে যাই। তারপর কী যে সব হল! বলছি, শুনতে পাচ্ছেন? ছেড়ে দিন, মরি বাঁচি আবার সেখানেই ফিরে যাব। পাপ কি সয় গো ধর্মে? এ বাড়িতে ঝিয়ের বেশি আর কিছু হতে চাইনি তো। পাপ করলে তাড়িয়ে দেবে। তবু পাপ তো হলই। বেশি চেয়ে ফেললাম যে মনে মনে। এবার চলে যাব। চলে যাব।
সেই বিশাল পুরুষ যখন আর এক পা এগোল তখন বনানীর চোখ ভরে টস টস করে নেমে এল জল। মা গো! আর সয় না তো! আর সয় না তো!
চকিতে মনে পড়ল পিছনে রেলিং, তার ওপাশে অবাধ তিন তলার শূন্যতা। একটু দুলিয়ে দিলেই হয় নিজেকে।
আর কী করার ছিল বনানীর? অবোধ, ভাষাহীন ভয়ে আপাদমস্তক অসাড় বনানী নিচু রেলিং-এর ওপর দিয়ে নিজেকে ঠেলে দিল পিছনের দিকে। মা গো!
০৭. একজোড়া বিষাক্ত সামুদ্রিক সাপ
পক প্রণালীতে একবার একজোড়া বিষাক্ত সামুদ্রিক সাপ তার সঙ্গে অনেকক্ষণ সাঁতার কেটেছিল। অলক ভয় পায়নি। জলে তার কোনও কিছুকেই ভয় নেই। হাঙর, কুমির, কামট কাউকেই নয়। জলে যদি কোনওদিন তার মৃত্যু হয় তবে সে এক অনন্ত অবগাহনের আহ্লাদ বুকে নিয়ে যাবে।
আজ হেমন্তের এক কুয়াশামাখা সকালে একটি মৃতদেহের মতো চিত হয়ে জলে স্থির ভেসে ছিল অলক। আকাশের রং এখনও কুয়াশার সাদা আর আঁধারের কালোয় মাখা ছাইরঙা। আজ তার সেই সাপদুটোর কথা খুব মনে পড়ছিল। তার দু’পাশে চার-পাঁচ গজের মধ্যেই দুই যমজ ভাইয়ের মতো প্রকাণ্ড সেই সাপদুটো কিছুক্ষণ পাল্লা টেনেছিল। সামনে গার্ডের নৌকোয় প্রস্তুত ছিল রাইফেল, হারপুন, শার্ক রিপেলন্ট, আরও সব অস্ত্রশস্ত্র। কিন্তু অলক গার্ডদের ডাকেনি। সাপদুটোকে পাল্লা টানতে দিয়েছিল তার সঙ্গে। ওই সাবলীল গতি, জলের সঙ্গে ওই মিশে থাকা একাত্মতা দুটো সাপের কাছ থেকে শিখে নিচ্ছিল সে। যেমনটা সে বার বার শিখেছে মাছ ও কুমির, হাঙর বা কামটের কাছেও।